২৫ মার্চ, ২০২৩
ছবি: প্রতিকী
ধর্ম মানুষকে মানবিক হতে শেখায়। সৃষ্টির কল্যাণকে ধর্ম-কর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইসলাম বলছে, ‘ধর্ম হলো (সৃষ্টিকুলের) কল্যাণকামিতা’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৫)। এই ধারাবাহিকতায় পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে মানবতা ও সৌহার্দ্যের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়।
সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা আর কল্যাণ কামনার প্রকৃত শিক্ষা মাহে রমজানের মাধ্যমে আমাদের অন্তর ও জীবনজুড়ে প্রতিফলিত হতে হবে। রমজানে ইবাদতের পাশাপাশি মানবিক কিছু বিষয়ের শিক্ষা অর্জন করাও আবশ্যক।
গরীবের কষ্ট অনুধাবন
সওম হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখা। অভুক্ত-অনাহারে থেকে একধরনের সাধনা করা হলো রোজার মৌলিক প্রতিপাদ্য। ক্ষুধার্ত মানুষ বছরের ১২টা মাস কীভাবে কাটায় রোজা আমাদের মাঝে সে উপলব্ধি জাগ্রত করে। বিশ্বব্যাপী মানুষ নিজের সুখ, নিজের সমৃদ্ধি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যক্তিকে করে তুলেছে আত্মস্বার্থনির্ভর দ্বিপদবিশিষ্ট এক অদ্ভুদ প্রাণি হিসেবে।
রোজা এ ধরণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে অনাহারি অভুক্ত মানুষের কথা ভাবতে শেখায়। পৃথিবীর দেশে দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতিচ্ছবি রোজাদারের সামনে ভেসে ওঠে। রোজাদার উপলব্ধি করতে পারে মানব সন্তানের কষ্টময় জীবন। এ উপলব্ধি তাকে সকলকে নিয়ে সুখি হয়ে বাঁচতে শেখায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ তাৎপর্য আমরা কতটুকু ধারণ করি? সাহরি ও ইফতারে পেটপুরে অতিভোজন আমাদেরকে রোজার প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়। অতিরিক্ত আহারের ফলে মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। ইফতার ও সাহরিতে আমাদের নবীজি বরাবরের মত সামান্যই আহার করতেন। কিন্তু আমাদের অতি আহারে বেদনাক্লিষ্ট মানুষের মুখগুলো আমাদের সামনে আর ভাসে না।
রমজানে পৃথিবীব্যাপী অভুক্ত মানুষের কষ্টের কথা ভাবতে হবে। তাদের প্রতি সহমর্মিতা জাগ্রত করতে হবে। নিজের আশপাশের দরিদ্র মানুষগুলোর চেহারায় হাসি ফোটাবার চেষ্টা করতে হবে। তাদের প্রতি সহমর্মিতা জাগ্রত করতে হবে। মাহে রমজানে প্রশিক্ষণ নিয়ে বছরজুড়ে এর চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। কেবল আমার সুখই সুখ নয়, মানুষের সুখের মাঝে আমি খুঁজে ফিরবো আমার প্রকৃত সুখ; রোজার তাৎপর্য এখানেই।
শ্রমিকের শ্রম হালকা করা
রমজানে কর্মচারিদের কষ্টের বোঝা হালকা করার নির্দেশ এসেছে। শ্রমিকদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার অসামান্য। তার শ্রমঘণ্টা, শ্রমমূল্য, সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ইসলামে সুন্দরতম উপায়ে সংরক্ষিত। তদুপরি মাহে রমজানে শ্রমিকের কষ্ট হালকা করার নির্দেষ দিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে তার গোলাম তথা কর্মচারিদের কাজের বোঝা কমিয়ে দেয় আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। আমাদের দেশে বিপরীত পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এখানে ঈদ উপলক্ষ্যে মানুষের শ্রমের পরিমাণ বেড়ে যায় দ্বিগুণ-তিনগুণ। পরিশ্রমী মানুষগুলো রোজা রাখতেও ভুলে যায়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, সামাজিক রীতিনীতি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
মানুষকে আহার করানো
হাদিসে আছে, ‘রোজাদারকে ইফতার করালে রোজাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-১৭০৭৪)। নবীজি মানুষকে আহার করানোর জন্য এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মন ভরে ইফতার বিলাতে হবে। রোজাদারকে ইফতার করানোর মধ্য দিয়ে মানুষকে আহার করানোর একটি মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পরিচিত-অপরিচিত সবার প্রতি সমান ভালোবাসা নিয়ে ইফতার বিলাতে হবে। অপরের পাশে দাঁড়ানোর এই মূল্যবান মানসিকতার মধ্য দিয়ে আভিজাত্যের একটা চর্চা নিজেদের জীবনে সৃষ্টি করতে হবে। বছরের বাকি দিনগুলোতেও সৃষ্টির প্রতি যথাযথ বদান্যতা প্রদর্শন করতে হবে। এগুলোই রমজান শিখিয়ে যায়।
সুন্দর আচরণ
মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা একটি ইবাদত। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম সে যার আচরণ ভালো, যার চরিত্র সুন্দর’। রমজান মাসে মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নবীজি বলেছেন, ‘যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে তুমি বল যে আমি রোজাদার’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৪)। এর মানে হলো তুমি তার মত কটু কথা বলো না। নিজেকে কটুভাষী হিসেবে উপস্থাপিত করো না। সংযত হয়ে বলো আমি রোজাদার। অনাকাঙ্খিত একটি আচরণের বিনিময়ে তুমি কাঙ্খিত সুন্দর আচরণ প্রদর্শন করো।
সহযোগিতা সহমর্মিতা
রমজান সহযোগিতা সহমর্মিতার মাস। এ সহযোগিতা কোনো দেশ কাল পাত্র কিংবা কোনো আদর্শ ও দর্শনের সঙ্গে সীমিত নয়। স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতা সহমর্মিতার শিক্ষা রমজান আমাদের দিয়ে যায়। রমজানে ইবাদতের অনেক ফজিলত রয়েছে। ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের পাশাপাশি আমরা কিছু মানবিক দিকের কথা তুলে ধরেছি। এগুলোও ইবাদত। এই মানবীয় গুণাবলিগুলো অর্জন করার মধ্য দিয়ে যাবতীয় ইবাদত পূর্ণতা পাবে। রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য অন্তরে ধারণ করতে হলে এই গুণাবলিগুলোর আলোকে নিজের জীবন সাজাতে হবে। মানবিকতা, পরোপকারিতা, উদারতা, দানশীলতা অপরের কল্যাণ কামনা রোজার প্রকৃত শিক্ষা। এসব শিক্ষার আলোকে ব্যক্তির যাপিত জীবন সাজিয়ে একটি আলোকিত রাষ্ট্র এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে উৎসর্গিত হোক প্রতিটি মানুষের সিয়াম সাধনা।
লেখক: মুহাম্মদ গোলাম আজম
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (অধ্যায়নরত), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
ধন্যবাদ 🌸💚
Good news