০৮ নভেম্বর, ২০২৫
ছবি: মোহাম্মদ রায়হান ও মোবারক ইমন
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর খোন্দকারাবাদে বুধবার সন্ধ্যায় চলছিল সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগ। মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যেই আচমকা গুলি। টার্গেট আলোচিত ‘সন্ত্রাসী’ সরওয়ার হোসেন বাবলা। ৭ পয়েন্ট ৬২ বোরের পিস্তল তাঁর ঘাড়ে ঠেকিয়ে গুলি চালান একজন। তিনটি গুলির পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বাবলা। ভিডিও ফুটেজ দেখে কে গুলি চালিয়েছে তা জানাতে না পারলেও এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে যে রায়হান-ইমন জুটি ছিল– সেটা নিশ্চিত করেছেন পুলিশ ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গত ১৪ মাসে এই জুটির বিরুদ্ধে বাবলাসহ ৯টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবু পুলিশ তাদের টিকিও ছুঁতে পারেনি। এদিকে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, হয়নি মামলাও।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এলাকার নির্মাণাধীন ভবনে ইট-বালু সরবরাহ, বালুমহাল ও প্লট ভরাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই এই হত্যাকাণ্ড। বাবলা হত্যায় গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যাদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব রাউজানের বদিউল আলমের ছেলে রায়হান (৩৫), ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর গ্রামের মোহাম্মদ মুসার ছেলে মোবারক হোসেন ইমন (২২), নগরের খুলশী সিডিএ পুনর্বাসন এলাকার খায়রুল আলমের ছেলে বোরহান (২৭) ও রাউজানের পরীর দীঘির পাড়ের আনোয়ার হোসেনের ছেলে মো. খোরশেদ (৪৫)।
পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, চারজনই গুলি চালাতে সিদ্ধহস্ত। তারা কারাগারে থাকা সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের অনুসারী। ছোট সাজ্জাদ বিদেশে পালিয়ে থাকা আরেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী।
৯ খুনে রায়হান-ইমন
গত বছর ২৯ আগস্ট রাতে কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়ছারকে (৩২) গুলি করে হত্যা করা হয়। দুজনই যুবলীগের কর্মী ছিলেন। তারা বাবলার সঙ্গে ব্যবসা করতেন। একই বছরের ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়া এলাকায় গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসীন (২৬) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। তিনিও বাবলার সঙ্গে এলাকায় ইট-বালুর ব্যবসা করতেন।
গত ২৯ মার্চ রাতে নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোডে বাবলাকে টার্গেট করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এতে বাবলার দুই সহযোগী বখতেয়ার হোসেন মানিক ও আব্দুল্লাহ আল রিফাত খুন হন। গত ২৩ মে রাতে নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করা হয় ঢাকাইয়া আকবরকে। গত ২৫ অক্টোবর রাউজানে যুবদল কর্মী মো. আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা ও এর আগে ১১ এপ্রিল রাউজানে যুবদল কর্মী ইব্রাহিম হত্যায়ও জড়িত রায়হান-ইমন জুটি। এসব হত্যা মামলার প্রায় সবকটির আসামি রায়হান, ইমন, বোরহান ও খোরশেদ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) হাসিব আজিজ বলেন, হত্যায় জড়িতদের সঙ্গে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের যোগসাজশ রয়েছে। অনেক দুর্গম এলাকায় তাদের আস্তানা।আমরা সেখানেও অভিযান চালিয়েছি। তবে সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তারা মোটরসাইকেলে এসে ঘটনা ঘটিয়ে দ্রুত চলে যায়। একই কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শান্ত।
স্থানীয় সূত্র ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ জনসংযোগে যাবেন এ তথ্য আগেই ছিল হত্যাকারীদের কাছে। বুধবার বিকেলে এরশাদ উল্লাহ খোন্দকারাবাদে জনসংযোগ শুরু করেন। বাবলার বাড়ির পাশে হযরত ইজ্জত উল্লাহ শাহ মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়েন তিনি। নামাজের পরে হত্যাকারীরা বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে মিশে যায়। এক পর্যায়ে বাবলার ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়। গুলির শব্দ পেয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ এরশাদ উল্লাহকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়া বাবলাকে আরও কয়েক রাউন্ড গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে নির্বিঘ্নে চলে যায় সন্ত্রাসীরা।
পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাবলা সবসময় অস্ত্র নিয়ে চলতেন। হত্যার দিন তাঁর সঙ্গে অস্ত্র ছিল না, এটা তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠ সহযোগীর কাছ থেকে তথ্য পেয়েছিলেন হত্যাকারীরা। তাই তারা বাবলার বাড়ির সামনে খুন করার ছক কষে। এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে গেলে তিনি বাড়ি থেকে বের হবেন, এটা খুনিরা নিশ্চিত ছিল। কারণ দেড় মাস আগে বাবলার বিয়েতে এরশাদ উল্লাহসহ অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই এলাকার কোনো ভবনে সিসি ক্যামেরা ছিল না। যার কারণে হত্যাকারীরা খুন করে কোন দিকে পালিয়েছে তা জানা যায়নি। জনসমাগম থাকায় হত্যাকাণ্ডের সময় অস্ত্রধারী কতজন ছিল তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হত্যার ধরন ও অস্ত্রের ব্যবহার দেখে তারা নিশ্চিত হয়েছেন ঘটনাস্থলে রায়হান, ইমন, বোরহান ও খোরশেদ ছিল। এই চারজনের গতিবিধির ওপর নজরদারি করা এমন কয়েকটি সূত্রও তাদের উপস্থিতির কথা নিশ্চিত করেছে।
নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর খোন্দকারাবাদ ফতেপুকুর পাড়ে যখন বাবলাকে গুলি করা হয়, তখন অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাবা আবদুল কাদের। গুলির শব্দে অন্যরা পালিয়ে যান। ছেলেকে দোকানের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে যান তিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ আবদুল কাদেরের পক্ষে ছেলেকে টেনে তোলা সম্ভব হয়নি। পরে অনেক ডাকাডাকি করে আরও দুজনের সহায়তায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় তুলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বুধবার মধ্যরাতে সেই মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আবদুল কাদের। একপর্যায়ে বলেন, ‘রায়হান আমার ছেলেকে খুন করেছে। তিন দিন আগেও ফোনে হুমকি দিয়েছিল। আমার ছেলে বলেছিল, ফোনে গালিগালাজ না করে সাহস থাকলে সামনে আয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় সময় ফোনে আমার ছেলেকে গালিগালাজ করত রায়হান। হুমকি দিত। তারা মনে করত বুড়ির নাতি সাজ্জাদকে (ছোট সাজ্জাদ) গ্রেপ্তারের পেছনে আমার ছেলের হাত আছে। কয়েক মাস আগে সাজ্জাদের অনুসারী রায়হানসহ চারজনের বিরুদ্ধে থানায় জিডিও করেছিলাম।’
জেল ও বিদেশে বসে পরিকল্পনা
বায়েজিদ বোস্তামীর জান আলী নগর চালিতাতলী এলাকার আব্দুল গনি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায় শীর্ষ এই সন্ত্রাসী। অন্যদিকে সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ হাটহাজারীর শিকারপুর গ্রামের সোনা মিয়া সওদাগর বাড়ির মো. জামালের ছেলে। গত ১৫ মার্চ রাতে ছোট সাজ্জাদকে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী শারমিন আক্তার তামান্না বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন, তাদের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে বাবলা।
স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর, নুর আহমদ ও আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, সাজ্জাদ বাহিনী ছাড়ার পর বাবলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাজ্জাদের লোকজনকে ধরিয়ে দিতেন, এতে ক্ষিপ্ত ছিল তারা। এর জেরে বাবলাকে সরিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে সাজ্জাদ বাহিনী। কারাগারে বসে হত্যার ছক কষে ছোট সাজ্জাদ। পুরোনো যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশে বসে অস্ত্র জোগাড় করে দেয় বড় সাজ্জাদ। মাঠে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তাদের অনুসারীরা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) হাসিব আজিজ বলেন, এ ঘটনার মূল কুশীলব কারাগারে। বিদেশ থেকেও ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে। সব তথ্য আমাদের কাছে আছে।
নেপথ্যে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ
বিদেশে বসে চট্টগ্রাম নগরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সাজ্জাদ আলী খান। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন নুরুন্নবী ম্যাক্সন, সারোয়ার হোসেন বাবলা ও ঢাকাইয়া আকবর। ২০১৭ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে চলে যান ম্যাক্সন। ২০২২ সালে ভারতে মারা যান তিনি। ২০২০ সালে কাতার থেকে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন বাবলা। জামিনে বেরিয়ে সাজ্জাদ বাহিনী ছাড়েন। একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর দলছুট হন ঢাকাইয়া আকবরও। এরপর ছোট সাজ্জাদকে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলেন বড় সাজ্জাদ। ২০১৫ সাল থেকে বড় সাজ্জাদের সাম্রাজ্য দেখভাল করতেন ছোট সাজ্জাদ। বিদেশ থেকে ফোন দিয়ে চাঁদা দাবি করতেন বড় সাজ্জাদ। চাঁদা দিতে কেউ অস্বীকার করলে গুলি করে কিংবা কারখানা জ্বালিয়ে দিতেন ছোট সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগীরা।
নগরের পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, খুলশী ও হাটহাজারীর এলাকায় এখন শহর সম্প্রসারণ হচ্ছে। উঠছে নতুন নতুন দালান। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে জামিনে বেরিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে মিলে এসব এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে ইট-বালু সরবরাহ ও খালি প্লট ভরানোর কাজ করতেন বাবলা। গত বছর ৫ আগস্টের পর এসবের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন বাবলা। এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় সাজ্জাদ ও ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব চলছিল। বাবলা ছিলেন চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা ছিল ১৫টি।
বাবলার বাবা আবদুল কাদের বলেন, আমার ছেলে ওয়াজেদিয়া এলাকায় অন্তত দুইশ প্লট ভরাট করেছে। ইট-বালুও সরবরাহ করত। এগুলো কেড়ে নিতে চাচ্ছিল ছোট সাজ্জাদ। এই ব্যবসা কেড়ে নিতে না পেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে।