০৬ মে, ২০২৩
ছবি: চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান চুক্তি সম্পন্ন
১০ ই মার্চ সৌদি আরব এবং ইরান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একটি চুক্তি করেছে। দীর্ঘ দুই বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর চীনের মধ্যস্থতায় অবশেষে উভয়পক্ষ চুক্তিটি স্বাক্ষরে সম্মত হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনীয় গুতারেস সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে তারা চুক্তি সম্পর্কে পূর্বে থেকেই অবগত ছিল।
দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে বিভক্ত ছিল। সৌদি ইরান চুক্তিতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে চীন মধ্যপ্রাচ্যে তার স্বতন্ত্র প্রভাব বলয় তৈরী করতে সক্ষম হলো।
সত্যিই কি এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে ক্ষুন্ন করতে সক্ষম হয়েছে? এক কথায় বলা যায় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছে চীন।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় টালমাটাল সারা বিশ্ব।ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের হার হলে অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হবে চীন, আর সামরিক সুপার পাওয়ার হিসেবে বিশ্বে রাশিয়ার অবস্থান আরো সুদৃঢ় হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভূরাজনীতির বড় পরিবর্তন ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। পরস্পর বিরোধী দেশগুলো উদ্যোগ নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে আনার। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে বিশ্বের নানাপ্রান্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এই যুদ্ধ বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী চারটি দেশ সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, এবং আরব আমিরাত, পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে এসব দেশ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহনের বিষয়টিতে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ভৌগোলিক ও সামরিক দিক দিয়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। সৌদি ও ইরানের অবকাঠামো নির্মাণে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে চীন। এদিকে ইয়েমেনে চলছে সৌদি ও ইরানের প্রক্সি ওয়ার। ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা ক্রমান্বয়ে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আরব আমিরাতকে লক্ষ্য করে। আমেরিকার তৈরি মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা এই হুতি আক্রমণ প্রতিহত করতে পারছে না সৌদি ও আরব আমিরাত। সৌদি আরবের অবরোধের কারণে ইয়েমেনে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষাবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায়না ইয়ামেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক। বিশ্ব জনমত এবং মার্কিনিদের চাপ বাড়ছে মার্কিন প্রশাসনের উপর যুদ্ধ বন্ধের। সৌদি আরবও ইয়ামেনে চাচ্ছে একটি সম্মানজনক সমাধান।
এদিকে রাশিয়ার সহায়তায় দেড় হাজার কিলোমিটার পাল্লার এবং শব্দের চেয়ে ৮ গুণ বেশি গতির হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে সম্প্রতি ইরান। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রাপ্তি ইরানকে করে তুলেছে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী। ইরানের শক্তিশালী উত্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক অশনি সংকেত হিসাবে দেখছিল সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা। ইয়েমেন থেকে হুথি আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। কিন্তু ইরানের সাথে সংলাপের কার্যকর মধ্যস্থতা কারীর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই কার্যকর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় উভয় দেশের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে চীন।
ইরান দীর্ঘদিন যাবত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দ্বারা কঠোরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল বাণিজ্যে ধস নামে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের সাথে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক কয়েকটি দেশের মধ্যে চীন অন্যতম। ২০১৬ সালে চীন ইরানের সাথে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চীনে ইরানের তেল রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তেহেরান এবং মাসহাদের মধ্যে দূরত্ব ৭৩৬ কিলোমিটার এই দুই প্রদেশের মধ্যে একটি উচ্চ গতিসম্পন্ন রেল নেটওয়ার্ক নির্মাণসহ ইরানের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করছে চীন।
সৌদি আরবেও চীনের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরব চীনের সাথে ৬৫ বিলিয়ন ডলারের একটি সিরিজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার মধ্যে চীনে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স ও শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এবং যা ২০২৪ সালে কার্যক্রম শুরু করবে। সৌদি আরব তার ভীশন ২০৩০ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে আগ্রহী। যা দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং তেলের উপর নির্ভরতা কমাতে দেশটিকে সাহায্য করবে। সৌদি আরব এখন চীনের সহায়তায় নিজস্ব ব্যালেষ্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আয়ত্তের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
সার্বিক দিক বিবেচনায়, সৌদি আরব ও ইরানের পূর্বের তিক্ততা ভুলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি ওয়ারের পরিধি সীমিত করার উপলব্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। উভয়ের কাছেই এই মুহূর্তে চীন একটি কার্যকরী বন্ধু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সৌদি আরব এবং ইরান উভয় রাষ্ট্রের কাছেই চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য দেশ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। ইয়েমেন সমস্যা সৌদি ইরান উভয়েরই গলার কাঁটা। যুক্তরাষ্ট্রও যেকোনোভাবেই হোক ইয়েমেন সমস্যার দ্রুত সমাধান চায়।
সৌদি-ইরান সম্পর্ক উন্নয়নের চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। ইরানের সাথে উত্তপ্ত সম্পর্কের কারনে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অথচ চুক্তি স্বাক্ষরের তিনদিনের মাথায়, গত ১৩ ই মার্চ আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ের চুক্তি বাতিল করেছে।একইসাথে জাতিসংঘে ইরানের মিশন বলেছে, ‘সৌদি আরবের সাথে চীনের মধ্যস্থতায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চুক্তি, ইয়েমেনের দীর্ঘ যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক মীমাংসা আনতে সাহায্য করবে। ইয়েমেন ইস্যূতে তেহরানের মনোভাব সৌদি ও তার মিত্রদের মনে আস্থা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
ইরানের সাথে সৌদি জোটের সম্পর্ক স্বাভাবিকিকরনে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অন্যায় ও অবৈধ কার্যক্রমে সবার পর্যবেক্ষন বাড়বে। ইরান পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার প্রক্সি বাহিনীগুলোকে শুধুমাত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে সক্রিয় করতে সচেষ্ট হবে। ইসরাইলও বসে থাকবেনা। ইসরাইলও পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের পোষ্য এবং ভয়ংকর গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে এই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে। তবে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহ, সেটাই প্রত্যাশা।