১০ এপ্রিল, ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত ছবি
সাইফুর রহমান বাদল
ফিতরা বা ফেতরা فطرة আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর -ফিতরের যাকাত বা সাদাকাতুল ফিতর -ফিতরের সদকা নামে পরিচিত। ফিতর অথবা ফাতুর বলতে খাদ্যদ্রব্যকে বোঝানো হয়েছে যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ অর্থাৎ ইফতার করেন। যাকাতুল ফিতর হলো ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের দান করাকে বুঝাই। রোজা পালনের পর সন্ধ্যায় অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ইফতার করা বা খাদ্য গ্রহণ করা হয়। আর রমজান মাস শেষে ঈদ উপলক্ষে দান করাকে যাকাতুল ফিতর বা খাদ্যের যাকাত বলা হয়।
স্বাধীন - পরাধীন, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল সঃ বলেছেন -
" প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রীতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব ফরজ করেছেন। তিনি লোকদের ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন"।
ফিতরা দেওয়ার বিধান কি?
কে ফিতরা দেবে বা ব্যক্তির ফিতরা ফরজ-
ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য কাদের আছে (একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করা ফরজ যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত হয়েছে যার নিকট এক বা দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু নেই তার ফিতরা দেয়ার প্রয়োজন নেই।
কারা ফিতরা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত -
গরীব, দুঃস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিদেরকে ফিতরা প্রদান করা ইসলামে বিধান আছে।
বেতনভুক্ত কর্মচারীকে ফিতরা দেওয়ার বিধান -
বেতনভুক্ত কাজের ব্যক্তির পক্ষে ফিতরা প্রদান করা মালিকের উপর আবশ্যক নয়। যদি মালিক ইচ্ছে করে কাজের লোককে ফিতরা প্রদান করেন তবে সেটা করতে পারেন । কিন্তু তিনি বেতন বা পারিশ্রমিক হিসেবে ফিতরা প্রদান করতে পারবেন না এটা সঠিক হবেনা।
কি দিয়ে ফিতরা দেবেন এর বিধান কি-
আবু সাঈদ খুদরী রা: বর্ণনা করেছেন “আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ দিয়ে। এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম উল্লেখ আছে তা হলো কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবী সঃ এর ওফাতের পরে মুআবীয়া রা: -এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা প্রদান করেছেন এমন উল্লেখও আছে।
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা জানা যায় খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা প্রদান করা যাবে। যেহেতু চাল বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান খাদ্য সেহেতু চাল দিয়েও ফিতরা প্রদান করা অবৈধ নাই । চালের বদলে যদি ধান দিয়ে কেউ ফিতরা দিতে চাই তবে অবস্যই ওজনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে । কারণ এক সা ধান এক সা চালের সম মূল্যের হবে না। কুরআন থেকে জানা যায়-
" তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না। অথচ তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও"।
তবে ধানের বদলে চাল দিয়ে ফিতরা প্রদান করা উত্তম। নিম্নোক্ত কিয়াস থেকে এই ব্যাপারে যে ধারণা পাওয়া যায় তবে চাল দিয়ে ফিতরা দেওয়ায় ভালো।
যবের উপর কেয়াস (অনুমান) করে ধানের ফিতরা জায়েয হইবে না, কারণ ধান আদৌ খাবার সামগ্রী ‘তাআম’ নাই। আহার্য বস্তুর উপর কিয়াস করিয়া যব বা খুর্মার ফিতরা দেওয়া হয় না মনসূস ( কুরআন বা হাদীসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত) বলিয়াই দেওয়া হইয়া থাকে। তাআম বা আহার্য সামগ্রীরূপে ফিতরা দিতে হইলে এক সা চাউল দিয়ে দিতে হইবে।
টাকা দিয়ে কি ফিতরা দেয়া শরিয়তের অনুমোদন আছে কি?
মুহাম্মদ (সঃ) এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিলো। দিরহামের দ্বারা কেনা কাটা, দান খয়রাত করা হতো। তবু সাহাবী খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় মুহাম্মদ (সঃ) খাদ্য বস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করতেন। এজন্য মুসলমান পন্ডিতদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষন করেন। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ হওয়ার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না।
তবে প্রয়োজনে টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা যাবে । বাংলাদেশের মুসলিমগণ যদি টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাই তবে ২.৪০ (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) মধ্য মানের চাউলের মূল্য পরিশোধ করে সেই হিসাবে ফিতরা দিতে হবে । অবশ্য বাংলাদেশ যাকাত বোর্ড প্রতিবছর শহর ও গ্রাম এলাকার জন্য ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তবে সম্ভব হলে চাল বা খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করাই উত্তম
সা কি এবং নির্ধারণ করবো -
ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় সা বহুল পরিচিত শব্দ। সা হচ্ছে আরবদেশে ওজন বা পরিমাপে ব্যবহৃত পাত্র। বাংলাদেশে যেমন ধান পরিমাপের জন্য একসময় কাঠা ব্যবহৃত হত। একজন মাঝামাঝি শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হলো এক সা।
হাদিস সুস্পষ্ট আছে মুহাম্মদ (সঃ) এক সা পরিমাণ ফিতরা প্রদানের কথা বলেছেন এবং প্রদান করেছেন । মুহাম্মদ (সঃ) এবং চার খলিফার মৃত্যুর পরে মুআবিয়া (রাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্ক স্থানান্তরিত করেন তারপর থেকে তারা গমের সাথে পরিচিত হন।
সে সময় সিরিয়ার গমের মূল্য খেঁজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বসে বলেন: আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এর পর থেকে মুসলিম জনগনের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলনও শুরু হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর ভাবে ফিতরা আদায় করার তাওফিক দান করুক আমিন।
লেখক - কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
Good news
Good