০৭ নভেম্বর, ২০২২
ছবি: চাকরি হারানো দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ভাইয়ের দোকানে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটি মাঝারি আকারের কনফেকশনারি (দোকান)। সেই দোকানে ক্যাশিয়ার হিসেবে যিনি আছেন, তিনি এক বছর আগেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা ছিলেন। রোহিঙ্গা এনআইডি জালিয়াতি, কক্সবাজারের বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতিসহ চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে এনেছিলেন তিনি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছিলেন। পরে রাঘববোয়ালের রোষানলে পড়ে চাকরি হারানোর গল্পটা তো সবারই জানা। কোথাও চাকরি না পেয়ে সেই শরীফ উদ্দিন এখন ভাইয়ের দোকান সামলাচ্ছেন।
সোমবার দুপুরে ষোলশহর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা যায় দোকানের কাজে ব্যস্ত শরীফ। কর্মচারীরা খরিদ্দার সামলাচ্ছেন, সেদিকে চোখ রাখতে হচ্ছে। আবার পণ্যের দাম নেওয়া, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে হচ্ছে।
শরীফ বলেন, ‘দেখেন ভাই, আমার বউ-বাচ্চা আছে। মা অনেক দিন ধরে অসুস্থ। আমিও অসুস্থ। গত ৯ মাস আমার চাকরি নেই। দুর্নীতি যদি করতাম, তাহলে বসে বসে খেতে পারতাম। যেদিন থেকে বেতন বন্ধ, ওই দিন থেকে সংসারে টান পড়েছে। চাকরির জন্য সবার কাছে গেছি, বিডিজবসে আবেদন করেছি। কিন্তু দুদক সবখানে বলে দেওয়ায় কোথাও চাকরি হয়নি। তাই ভাইয়ের এই দোকানের ক্যাশে বসে সংসার সামলাচ্ছি।’
উপসহকারী পরিচালক হিসেবে শরীফ উদ্দিন প্রায় সাড়ে তিন বছর দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন যায়গায় অভিযান চালিয়ে দূর্নীতি বাজদের মুখোশ উন্মোচন করা এই কর্মকর্তা এমন মানবেতর জীবনযাপনের কারণ কি? কি আছে এর নেপথ্যে?
বিভিন্ন চানচঞ্চল্যকর অভিযান চালিয়ে দুর্নীতিবাজদের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের এই কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন। জনসম্মুখে প্রকাশ করছিলেন কক্সবাজার প্রকল্পের বিভিন্ন দূর্নীতি। রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতি ও কর্ণফুলী গ্যাসের অবৈধ নিয়োগ ও সংযোগ সহ বড় বড় প্রভাবশালীদের দূর্নীতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূর্নীতি দমনের জিরো টলারেন্স এর ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পূর্ণ মনোবল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আর তার এই এগিয়ে যাওয়ায় হলো কাল।
দেশে আইনের সুষ্ঠু বিচার না থাকা এবং প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপটে এ বছরই চক্রান্তের শিকার হয়ে চাকরি চলে যায় তার।
শরিফ উদ্দিন বলেন আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমানের আগেই আমাকে বরখাস্ত করা হয়। প্রভাবশালীদের বিরাগভাজনের কারণেই আমি চাকরিচ্যুত। সত্যি কথা বলতে কি বড় বড় দূর্নীতি আর অপকর্ম ধরে আজ আমার এই পরিনতি। দেশের জন্য কাজ করে আজ আমি মানবেতর জীবনযাপন করছি। এই দোকানে থেকে যে খুব সুখে আছি তা না। যাদের শাস্তির আওতায় আনতে চেষ্টা করে ছিলাম তারা প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকি দেয়। আমি মোটামুটিভাবে নিরাপত্তা হীনতায় আছি। আমাকে রাস্তার ফকির বানানো হবে, নয়তো দেশান্তরি করা হবে।
তিনি আরো বলেন, দেশের বিভিন্ন দপ্তরে চেষ্টা করেও কোন কাজ পাইনি। কারণ দুদকের ভয়ে কেউ চাকরি দেয় না। আমি একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার দুটি বাচ্চা, আমার মা আর আমার শাশুড়ী এই নিয়ে সংসার। ভাইদের সহযোগিতায় আজ আমি এই টুকু করছি। অনেক চেষ্টা করেও কোথাও কোন কিছু না পেয়ে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছি। তাও কোন সুফল এখনো পাইনি।
পেশা জীবনে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন পুরষ্কার পাওয়া এই কর্মকতার মানবেতর জীবনযাপন কাটছে গত নয় মাস ধরে। নির্বাচন পরিষদের এক পরিচালক সহ দশ জনের বিরুদ্ধে মামলার পর তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়। এর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও ৯৪ লাখ টাকা নিজের কাছে রাখা সহ আরো বেশ কিছু কারণ দেখিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।