২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
ছবি: প্রধানমন্ত্রীর সংকেতে চাকা ঘুরল মেট্রোরেলের
দীর্ঘ অপেক্ষার পর চাকা ঘুরল বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের। বুধবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উত্তরার স্টেশন থেকে সবুজ পতাকা নাড়িয়ে চলাচলের সংকেত দিলে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক এই ট্রেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীসহ আমন্ত্রিত ২০০ জন অতিথিকে নিয়ে আগারগাঁও স্টেশনে রওনা দেয় মেট্রোরেল।
এর আগে বেলা ১১টায় ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টর সি-১ ব্লকের মাঠে মেট্রোরেলের উদ্বোধনী মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী। ১১টা ৪ মিনিটে সরকারপ্রধান প্রথমে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। এর মধ্য দিয়ে মেট্রো যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। সূচনা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন এক দিগন্তের। ফলক উন্মোচনের পরই প্রধানমন্ত্রী মঞ্চের সবদিক ঘুরে হাত নেড়ে উপস্থিত লোকজনকে শুভেচ্ছা জানান। এরপরই মোনাজাত করা হয়।
পরে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট ও স্মারক নোট উন্মোচন করেন। সমাবেশস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রী উত্তরা স্টেশনে যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে মূল ফলক পরিদর্শন এবং স্টেশন প্রাঙ্গণে তেঁতুল গাছের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী টিকেট কাউন্টারে এমআরটি পাস কেনেন। পরে শেখ রেহানাও পাস কেনেন। কিনে ভাড়া পরিশোধ করে প্ল্যাটফর্মে যান। সেখানে কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে যান তারা। সেখানে অপেক্ষায় থাকা ট্রেনকে সবুজ পতাকা নেড়ে চলাচলের সংকেত দেন। স্টেশনে অপেক্ষমাণ ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। পরে স্মারক হিসেবে সংরক্ষণের জন্য সবুজ পতাকায় স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী।
অপেক্ষায় থাকা আরেকটি ট্রেনে করে সহযাত্রীদের নিয়ে আগারগাঁওয়ের উদ্দেশে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও সরকারপ্রধানের সঙ্গে রয়েছেন। দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ে।
এর আগে সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেট্রোরেল দেশের অগ্রযাত্রার মুকুটে আরেকটি পালক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, একটা অনুরোধ থাকবে, অনেক টাকা খরচ করে এই মেট্রোরেল করা হয়েছে। এটাকে সংরক্ষণ করা, এটার মান নিশ্চিত রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা- এই সবকিছু কিন্তু যারা ব্যবহার করবেন তাদের দায়িত্ব।
‘এখানে অনেক আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার হয়েছে। এই সমস্ত জিনিস যেন নষ্ট না হয়। ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকলে যত্নবান হবেন। খেয়াল রাখবেন কেউ যেন আমাদের রেল স্টেশনগুলিতে আবর্জনা-ময়লা না ফেলে, অপরিচ্ছন্ন করতে না পারে- সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুন্দরভাবে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে এটা ব্যবহার করার জন্য আমি সবাইকে আন্তরিক আবেদন জানাচ্ছি, অনুরোধ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানাব, যদি আপনারা কথাগুলি মেনে চলেন।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাত্রী হিসেবে রয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পোশাক কর্মী, রিকশা চালক, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাসহ দুই শতাধিক মানুষ।
যানজটের নগরী হিসেবে পরিচিত মেরাজধানী ঢাকাকে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার আওতায় আনার পরিকল্পনা থেকে নেয়া মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি অংশ চালু হওয়ার মাধ্যমে গণপরিবহনব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ হচ্ছে। মেট্রোর একাংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়াল খুলে দেয়া হলো। বৃহস্পতিবার থেকে নগরবাসীর জন্যও উন্মুক্ত হবে স্বপ্নের এই গণপরিবহনব্যবস্থা। সাধারণ মানুষ মুখিয়ে আছেন মেট্রোরেলে একবার ওঠার জন্য।
নগরবাসীর নতুন স্বপ্ন মেট্রোরেলে আপাতত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সেবা মিলবে। এতেই খুশি এসব এলাকার যাত্রীরা।
মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ছয়টি কোচ থাকছে। এর মধ্যে দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হয় ট্রেইলর কার। এতে থাকবেন চালক। মাঝখানের চারটি কোচ হচ্ছে মোটর কার। মাঝের ৪টি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন এবং ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন যেতে পারবেন। সাড়ে ৯ ফুট চওড়া কোচগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও যাত্রীরা যাত্রা করতে পারবেন। ট্রেনের কোচগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে স্টেশনে থামার পর মেঝে একেবারে প্ল্যাটফর্মের সমতলে থাকে। এতে যাত্রীরা সহজেই হেঁটে ট্রেনে উঠতে পারবেন। কোচের দুই পাশে আছে দুটি দরজা। তবে পুরোদমে চালুর পরে এমআরটি লাইন-৬ ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। ৬টি কোচ-সংবলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের জন্য মেট্রোরেলে কোনো হাফ ভাড়া থাকছে না। কারণ মেট্রোরেলে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা খরচের ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া যারা স্থায়ী কার্ড কিনে যাতায়াত করবেন, তাদের জন্য ১০ শতাংশ ছাড় আছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিনা মূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন। পঙ্গুদের জন্য ছাড় আছে। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা করে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা নেই মেট্রোরেলে।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও মেট্রোরেল চালুর পর দিন থেকে মেট্রোরেল চলবে দিনে চার ঘণ্টা। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত। এ সময় ট্রেন মাঝপথে কোথাও দাঁড়াবে না। তবে আগামী ২৬ মার্চের পর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরোদমে চলবে মেট্রোরেল।
৯টি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হবে বলে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জানিয়েছেন।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও চালু হওয়ার পর মতিঝিল পর্যন্ত চলবে ২০২৩ সালে এবং মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের পুরো রুট ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার কমলাপুর পর্যন্ত ২০২৫ সালে চালু হতে পারে। যদিও ২০২৪ সালে শেষ করার সময় নির্ধারণ করা ছিল।