০৬ জানুয়ারী, ২০২৫
ছবি: কক্সবাজার সদর হাসপাতাল
গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার জেলা জুড়ে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। শীত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা জনিত সর্দি জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা। কক্সবাজার জেলায় সদর হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে নতুন রোগী।
সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা প্রদান কালে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ পিংকি বড়ুয়া বলেন, শীত বাড়ায় এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই শিশু। ঠান্ডা জনিত সমস্যায় বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। যারা বেশি আক্রান্ত তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
চিকিৎসার জন্য আসা রোগীর স্বজনরা বলছেন ঠান্ডা ও ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এলে চিকিৎসক ভর্তি দিচ্ছেন। ওয়ার্ডে যাওয়ার পর রোগীর জন্য বেড পাওয়া তো দূরের কথা, মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নেওয়ার জন্যও জায়গা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। শিশু ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিটি বেডে একাধিক শিশুকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঠান্ডা জনিত রোগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি শিশুর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ৮০ জনের ওপরে।
রবিবার (৫ জানুয়ারী) হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে শিশু ওয়ার্ডে ঠান্ডা জনিত সহ অন্যান্য শিশু রোগী ভর্তি আছে শতাধিক। তাদের অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩ দিন থেকে ৭ দিন ধরে। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গত ৭ দিনে সদর হাসপাতালে ৫৬০ জন শিশু ঠান্ডাজনিত এবং জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এইসব শিশুদের বেশির ভাগই আসছেন উপজেলাগুলো থেকে। দিন দিন শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে সারাবছর জুড়েই সর্দি-কাশি ও ফ্লু এর সমস্যা হলেও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে, বিশেষত শীত ও বসন্ত কালে সমস্যাগুলো বেড়ে যায়।
এসব রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিছু উপদেশ মেনে চললে ঘরে বসেই নিজের যত্ন নেয়া যায়। তা ছাড়া কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমানো যায়।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। বেশি আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি দেওয়া হচ্ছে। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ আছে। কোনো সমস্যা নেই। শীতে শিশু এবং বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে ঠান্ডায় শিশুদের প্রতি বেশি নজর রাখতে হবে। গরম কাপড়চোপড় দিয়ে রাখতে হবে যেন তাদের ঠান্ডা না লাগে।
তিনি বলেন, অল্প সর্দি-কাশি ও ঠান্ডা জনিত সমস্যা দেখা দিলেই অনেকে ফার্মেসিতে গিয়ে ঔষধ সেবন করেন। যা কোনভাবে একজন অসুস্থ রোগীর জন্য নিরাপদ নয়। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় ফার্মেসিস্টরা রোগী গেলেই তাদেরকে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দিচ্ছে। এতে করে আক্রান্ত রোগীরা শারীরিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অসুস্থ হলে এসব ফার্মেসিতে না গিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
ডাঃ এস এম আশরাফুজ্জামান আরো বলেন, ঠান্ডা জনিত কারণে দ্রুত সর্দি-কাশি ও ফ্লু সারাতে প্রাথমিকভাবে কিছু পরামর্শ মেনে চলার উপর জোর দেন।
তিনি আরো বলেন, এসময় দরকার বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো, শরীর উষ্ণ রাখা। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। পানির পাশাপাশি তরল খাবার খাওয়া। যেমন: ফলের জুস, চিড়া পানি, ডাবের পানি, স্যুপ, ইত্যাদি।
পানিশূন্যতা এড়াতে এমন পরিমাণে তরল খাওয়া উচিত যেন প্রস্রাবের রঙ স্বচ্ছ অথবা হালকা হলুদ হয়। তাছাড়া গলা ব্যথা উপশমের জন্য লবণ মিশিয়ে কুসুম গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করুন। তবে ছোটো শিশুরা ঠিকমতো গড়গড়া করতে পারে না বলে তাদের ক্ষেত্রে এই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়। সর্দি-কাশির সঙ্গে যাদের শরীরে ব্যথা থাকে তাদের ক্ষেত্রে আদা পানি খুব ভালো কাজ করে। আদা চা সর্দি-কাশির জন্য উপকারী। যাদের সর্দি-কাশির সমস্যা হচ্ছে, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়ছে তাদের জন্য দুধ চা, কফির পরিবর্তে আদার রস বা আদা চা খুব ভালো কাজ করবে। কাশি ও সর্দিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থাকুন। বারবার আপনার হাত দুটি ধুয়ে নিন।
নাক ও চোখ বেশি বেশি ঘষবেন না। প্রয়োজনে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আহ্বান জানান এ চিকিৎসক।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মং টিংঞো বলেন, সারা বাংলাদেশের ন্যায় কক্সবাজারেরও শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। শীতের তীব্রতার সাথে সাথে ঠান্ডা জনিত রোগ যেমন বাচ্চাদের এ আর আই, সর্দি-কাশি রোগের পাশাপাশি হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা কয়েকদিন যাবত বাড়ছে। আপনারা জানেন আমাদের হাসপাতাল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট, কিন্তু রোগী ভর্তি থাকে প্রায় ৩ গুনের অধিক।
সংগত কারণে আগের তুলনায় ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির সংখ্যা একটু বেশি। তাছাড়া আপনারা জানেন এইটা জেলা হাসপাতাল হলেও এইটা মেডিকেল কলেজ হিসেবে গন্য হচ্ছে।
যারফলে বিভিন্ন উপজেলা থেকে রেফার হয়ে এখানে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে। আউটডোরে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন ২ থেকে আড়াই হাজার রোগী ও ভর্তি থাকেন প্রায় সাড়ে ৮শ থেকে সাড়ে ৯শ রোগী। এতে রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি আমাদের চাপও বাড়ছে। রোগী বেশি হওয়ায় চিকিৎসকরাও হিমশিম খাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, এসকল রোগীদের নিরবিচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন ত্রুটি নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ প্রতিবছর কেনা হয়।
নতুন অর্থ বছরের জন্য ইজিপি করেছি। হয়তো খুব শীঘ্রই এই অর্থ বছরের জন্য ঔষধ বরাদ্দ পাব। চলমান সময়ে সরকারের বরাদ্দকৃত ঔষধ পর্যাপ্ত আছে জানিয়ে কোন রকম সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এ-সময় সদর হাসপাতালের জন্য এনজিও সংস্থার বরাদ্দ বন্ধ হওয়ায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মং টিংঞো বলেন, উন্নয়ন সহযোগী এনজিওগুলো একসময় আমাদেরকে চিকিৎসক, ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম সহ অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ে সহযোগিতা করত। যা সেপ্টেম্বর মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। যারফলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছুটা প্রভাব পড়েছে। এনজিও প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় তিন মাস থেকে অনেক চিকিৎসক, নার্স বেতন পাচ্ছে না।
নতুন প্রজেক্ট শুরু না হওয়া পর্যন্ত সকলে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে আমরা নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। এই প্রজেক্টের কার্যক্রম শুরু হলে জনবল থেকে শুরু করে ঔষধ ও লজিস্টিক সাপোর্ট সহ পুরোদমে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও ঠান্ডা জনিত রোগী ভর্তির খবর পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার টিটু চন্দ্র শীল বলেন, শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকায় জেলার প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঠান্ডা জনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকেরা আন্তরিকতার সাথে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখযোগ্য শিশু ও বয়স্করা বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে লাইন ধরছেন। এছাড়া বর্তমানে ডায়রিয়া জনিত রোগীর সংখ্যাও দিনদিন বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
Good news
Good