২৪ অক্টোবর, ২০২৪
ছবি: লেখক
‘দ্বীন’ শব্দটি আরবি শব্দ এর একাধিক অর্থ রয়েছে। কুরআন মজীদে বিভিন্ন অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কোন্ স্থানে কি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিম্নের বাক্য থেকে বুঝা যাবে। যে বাক্যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঐ শব্দের অর্থ সঠিকভাবে বুঝার উপায় নেই। ‘দ্বীন’ শব্দের কয়েকটি অর্থ কুরআন পাকে সুস্পষ্টভাবে বর্নিত আছে।
১। প্রতিদান, প্রতিফল, বিনিময় ইত্যাদি।
২। আনুগত্য বা হুকুম মেনে চলা।
৩। আনুগত্য করার বিধান বা আনুগত্যের নিয়ম (যা ওহীর দ্বারা নির্ধারিত)।
৪। আইন অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে নিয়মের অধিনে চলে, অনুরূপ সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় (যা ওহীর মাধ্যমে নয় বরং মানুষের সৃষ্টি)।
কুরআন পাকের কয়েকটি আয়াত থেকে দ্বীন শব্দের এসব অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
১। প্রতিদান বা বিনিময় -
মানুষ এই পৃথিবীতে চলাফেরা করার মধ্য দিয়ে যেটা সে অর্জন করবে, সেটা ভালো হউক আর মন্দ হউক তার কর্মের প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা শেষ দিবসে বিচারের পর দেবেন।
পবিত্র কুরআনে বর্নিত আছেঃ
كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُونَ بِٱلدِّينِ
'না, তা নয়, বরং তােমরা প্রতিদানকে মিথ্যা মনে করেছে।' সুরা ইনফিতার: ৮২: ০৯।
এ আয়াত দুটিতে দ্বীন শব্দের অর্থ প্রতিদান, প্রতিফল, বিনিময় ইত্যাদি। আখেরাতে মানুষের কাজের যে বদলা দেয়া হবে তাই এখানে বর্নিত হয়েছে।
২। আনুগত্য বা হুকুম মেনে চলা-
আনুগত্য হলো বিনয় প্রকাশ করা, নিজেকে কারাে গােলাম বানানাে।” (লিসানুল আরব ১৩ খন্ড ১৬৪ পৃষ্ঠা) পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
أَفَغَيْرَ دِينِ ٱللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُۥٓ أَسْلَمَ مَن فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ
'তারা কি আল্লাহর দ্বীনের (আনুগত্যের) পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করছে? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সেগুলাে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁরই আনুগত্য করে এবং তাদেরকে তারই নিকট প্রত্যাবর্তন করানাে হবে।' আল ইমরান ০৩: ৮৩।
এখানে 'দ্বীন' শব্দটি আনুগত্য অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। অপর আয়াতে বলা হয়েছে:
فَٱعْبُدِ ٱللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ ٱلدِّينَ
“অতএব আল্লাহর ইবাদাত কর তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।” আয যুমার ৩৯: ০২।
আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেনঃ
وَقَٰتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ لِلَّهِۖ
'আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন (সকল প্রকারের আনুগত্য) আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।' আল বাক্বারা ০২: ১৯৩।
এখানে ফিতনা অর্থ আল্লাহর আনুগত্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ইসলাম বিরােধী শক্তি। যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে এখানে বলা হয়েছে যে, বিরােধী শক্তিকে এমনভাবে দমন কর যাতে আল্লাহর আনুগত্য করতে কেউ বাঁধা দিতে না পারে। এ তিনটি আয়াত নমুনা স্বরূপ দেয়া হলাে। কুরআনে এ জাতীয় আয়াত বিদ্যমান।
উল্লেখ্য যে, আনুগত্যই হলাে 'দ্বীন’ শব্দের মূল অর্থ।
৩। আনুগত্যের বিধান বা জীবন ব্যবস্থাঃ
إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلْإِسْلَٰمُۗ
'নিশ্চই আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনােনীত দ্বীন (আনুগত্যের বিধান বা জীবন ব্যবস্থা)।' সুরা আলে ইমরান ০৩: ১৯।
এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে তাফসীরে বাইযাবীতে বলা হয়েছে:
'আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযােগ্য নয়। আর তা হলাে তাওহীদ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত জীবন বিধানকে লৌহ বর্ম পরিধান করার ন্যায় গ্রহণ করা। (তাফসীরে বাইযাবী সুরা আল ইমরানের ১৯ নং আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ আছে।
অপর আয়াতে একই অর্থে ব্যবহার হয়েছে:
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ ٱلْإِسْلَٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى ٱلْءَاخِرَةِ مِنَ ٱلْخَٰسِرِينَ
'যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) চায়, তার কাছ থেকে তা কখনােই গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।' সুরা আলে ইমরান ০৩: ৮৫।
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবন ব্যবস্থা বা আনুগত্যের বিধান হচ্ছে। ইসলাম। অপর আয়াতে বর্নিত আছে -
شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحًا وَٱلَّذِىٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِۦٓ إِبْرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنْ أَقِيمُوا۟ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا۟ فِيهِۚ
'তিনি তােমাদের জন্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; (তা হচ্ছে ঐ জীবন ব্যবস্থা) যার ব্যাপারে তিনি নূহ (আ:) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আমি (আল্লাহ) তােমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তােমরা দ্বীন কায়েম করাে এবং এই ব্যাপারে (দ্বীন কায়েম করতে গিয়ে) একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়াে না।' সুরা শু'রা ৪২: ১৩।
অর্থাৎ আল্লাহ সব নবীকেই তাঁর নাজিলকৃত জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে ওহী বর্নিত আছে -
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
'তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর এই দ্বীনকে বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।' সূরা সফ ৬১ :০৯।
অন্য আয়াতে এ ঘােষণাও আছে -
أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى
'আজ আমি তােমাদের জন্য তােমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম।' সূরা মায়িদা ০৫ঃ ০৩।
অর্থাৎ জীবনে একমাত্র আনুগত্যের বিধান যাতে পালন করা যায় এবং কোন ক্ষেত্রেই অন্য কোন বিধান থেকে কিছু নিতে না হয় সেজন্য তােমাদের জীবন বিধান পূর্ণ করে দিলাম। উপরের আয়াতগুলাের মাধ্যমে দ্বীন’ শব্দের অর্থ ‘জীবন ব্যবস্থা এটি প্রমাণিত কুরআনে আছে।
৪। আইন অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে নিয়মের অধিনে চলেঃ
মানব রচিত আইন, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থা দ্বীন শব্দটি যেভাবে আল্লাহ প্রদত্ত আইন, বিধান, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয় তেমনিভাবে মানব রচিত আইন, বিধান, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِىَ دِينِ
“তােমাদের জন্য তােমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন। সুরা কাফিরূন ১০৯: ০৬।
এ আয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনে হকৃকেও দ্বীন বলা হয়েছে। মানব রচিত দ্বীনে বাতিলকেও দ্বীন বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَقَالَ فِرْعَوْنُ ذَرُونِىٓ أَقْتُلْ مُوسَىٰ وَلْيَدْعُ رَبَّهُۥٓۖ إِنِّىٓ أَخَافُ أَن يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَن يُظْهِرَ فِى ٱلْأَرْضِ ٱلْفَسَادَ
'আর ফিরআউন বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করবাে এবং সে তাঁর রবকে ডাকুক; নিশ্চয়ই আমি আশঙ্কা করছি, সে তােমাদের দ্বীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমীনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে।' সুরা মু'মিন ৪০: ২৬।
এখানে ফিরআউন তৎকালীন সমাজের মানব রচিত আইন, বিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দ্বীন বলে উল্লেখ করেছে। এমনিভাবে, ইউসূফ (আঃ) এর ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِى دِينِ ٱلْمَلِكِ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُۚ
'আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া বাদশার আইনে সে তার ভাইকে ধরা যায় না।' সুরা ইউসুফ ১২:৭৬।
অর্থাৎ যে চুরি করেছে তাকেই ধরতে হবে। দেশের আইনে দোষীর বদলে অন্য কাউকে ধরা যায় না।' এ আয়াতে 'দ্বীন’ শব্দটি মানুষ কর্তৃক রচিত আইন-বিধান এর অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে । অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
قَٰتِلُوا۟ ٱلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَلَا بِٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ ٱلْحَقِّ مِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَٰبَ
“তােমরা যুদ্ধ কর সে সকল লােকদের বিরূদ্ধে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে প্রতি ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীন গ্রহণ করে না। সুরা তাওবা ০৯: ২৯।
এই আয়াতের মধ্যেও স্পষ্ট দ্বীন শব্দটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক - কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
Good news
Good