৩০ এপ্রিল ২০২৫
হোম স্বাস্থ্য সারাদেশ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি ও বাণিজ্য খেলাধুলা বিনোদন আন্তর্জাতিক ধর্ম ও জীবন লাইফ স্টাইল শিক্ষা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পরিবেশ চাকরি বা ক্যারিয়ার মতামত আইন-আদালত কৃষি ও প্রযুক্তি বিশেষ সংবাদ অপরাধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বকাপ ফুটবল
জাতীয় / অর্থনীতি ও বাণিজ্য

সাত দেশেই আটকা বাংলাদেশের শ্রমবাজার

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২

জুয়েল রানা,
স্টাফ রিপোর্টার

ছবি: সাত দেশেই আটকা বাংলাদেশের শ্রমবাজার

বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৫০ জন দক্ষ কর্মী নেয়ার কথা ছিল উজবেকিস্তানের। নিজেদের চাহিদা মেটাতে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ২০২০ সালে চার্টার্ড ফ্লাইট পাঠিয়ে ২৩৯ জন কর্মীকে নিয়ে যায় দেশটি। পাইপ ফিটার টেকনিশিয়ান এবং ওয়েল্ডার হিসেবে এসব কর্মীকে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে নেয়ার পর দেখা যায়, এসব কর্মী সংশ্লিষ্ট কাজে যথেষ্ট দক্ষ নন। পরপর চারটি ফ্লাইটে লোক নেয়ার কথা থাকলেও এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো কর্মীই নেয়নি মধ্য এশিয়ার এই দেশটি।

উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, উজবেকিস্তান বিভিন্ন দেশে গ্যাস রপ্তানি করে। এ জন্য গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইনের পাইপ ফিটার অ্যান্ড ওয়েল্ডার চেয়েছিল তারা। কিন্তু কর্মী আনার পরে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি পরীক্ষা করে দেখল বাংলাদেশ থেকে নেয়া কর্মী তাদের চাহিদা অনুযায়ী হয়নি। এরপর তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।

মূলত দক্ষ কর্মী পাঠাতে না পারার কারণে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে পারছে না বাংলাদেশ। কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সেই প্রথাগত বাজার আর অদক্ষ কর্মীতেই ঘুরপাক খেতে হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি আর নতুন শ্রমবাজার ‍সৃষ্টি শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ১৭৬টি দেশে কর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৮৩ হাজার কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে, যা গত নয় বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়েছে।

৭ দেশে ৯০ শতাংশ কর্মী

 

বিএমইটির ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪ জন কর্মী বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন। এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ অর্থাৎ ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০৭ জন গেছেন শুধু সৌদি আরবেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী গেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ওমানে। এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশ যাওয়া কর্মীর ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৮ জন কর্মী গেছেন ওমানে। এর বাইরে উল্লেখ করার মতো রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯ শতাংশ (৯৪ হাজার ৫৮৯ জন), সিঙ্গাপুরে ৬ শতাংশ (৫৯ হাজার ১৩১ জন)। কাতারে ২২ হাজার ১৮৬ জন (২ শতাংশ), কুয়েতে ১৭ হাজার ৮৪৩ জন (২ শতাংশ) জর্ডানে ১২ হাজার ১১০ জন (১ শতাংশ)। এ দেশে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কর্মসংস্থান হয়েছে ৯১ শতাংশের।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান দৈনিক বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের কর্মীরা ১৭০টিরও বেশি দেশে যান বলে প্রচার করা হয়। একটা দেশে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যায় কর্মীরা গেলেই সে দেশকে শ্রমবাজার বলা যায়। সে হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মিলে ১৫-২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সীমাবদ্ধ। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে কোয়ালিটির দিকে নজর না দিয়ে কর্মীর সংখ্যায় নজর দেয়া হয়েছে। ইউরোপের কোনো একটা দেশে হয়তো ২০ লাখ লোক পাঠানো যাবে না। কিন্তু সেখানে যদি ২ লাখ কর্মী পাঠানো যায়, তাহলে সে দেশ থেকে যে প্রবাসী আয় আসবে তা মধ্যপ্রাচ্যে ৭-৮ লাখ লোক পাঠানোর তুলনায় কম নয়।’

৯ শতাংশ কর্মী গেছেন অন্যান্য দেশে

বিএমইটির তৈরি বিভিন্ন দেশে কর্মী যাওয়ার তালিকায় ২০টি দেশের নাম রয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, বেশি সংখ্যক কর্মী যান- এমন দেশের নাম উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ কর্মী যান সাতটি দেশে। বাকি ৯ শতাংশ বিশ্বের অন্যান্য দেশে গেছেন। বিএমইটির হিসাব অনুযায়ী, এত হইচই করে খোলা শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে গেছেন মাত্র ৩ শতাংশ কর্মী। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি প্রচলিত বাজার ধরা হলেও গত ১১ মাসে দেশটিতে গেছেন মাত্র ৬ হাজার ৬৯২ জন, যা এ বছর যাওয়া কর্মীদের ১ শতাংশেরও কম। মরিশাসে গেছেন ৫ পাঁচ হাজার ১০২ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪ হাজার ৭৫০ জন, ব্রুনাইয়ে দুই হাজার ৪৮৬ জন, লেবাননে ৬৮৭ জন, জাপানে ৪২৮ জন, যুক্তরাজ্যে ৬৬৪ জন, সুদানে ২৮৯ জন, ইরাকে ৫৪ জন, মিসরে ৩৫ জন, লিবিয়ায় ৭৫ জন এবং বাহরাইনে ১১ জন কর্মী। এ ছাড়া ‘অন্যান্য’ দেশে ১৯ হাজার ৭৯২ জন গেছেন বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে। অল্প সংখ্যক কর্মী যান এমন দেশগুলোকে আলাদা না করে ‘অন্যান্য’ নামে একসঙ্গে হিসাব দেখানো হয়।

উজবেকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, দেশটিতে যাওয়া কর্মীদের বেতন ছিল সর্বনিম্ন ৪০০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ ডলার। যেখানে সৌদি আরবে একজন কর্মী ৬০-৭০ ডলার বেতন পেয়ে থাকেন। কিন্তু দক্ষ কর্মী পাঠানোর অভাবে সম্ভাবনাময় এই শ্রমবাজারটি হারাল বাংলাদেশ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী না পাঠানোর বিষয়টি উজবেকিস্তানের মিডিয়াতে প্রচার হওয়ার ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশটির একজন সংসদ সদস্য সেখানকার সংসদে বিষয়টি তুলে বাংলাদেশের সমালোচনাও করেন। এরপর থেকেই মূলত বাংলাদেশি কর্মী নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ হারায় উজবেক কর্তৃপক্ষ

বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষতা আর নতুন বাজার সৃষ্টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ সাধারণত অদক্ষ ও আধা দক্ষ কর্মী পাঠায়। এসব কর্মীর মূল গন্তব্যই হলো মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মূলত দক্ষ কর্মী চায়। দক্ষ কর্মী তৈরি না করার ব্যর্থতাই নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। তা ছাড়া শ্রম কূটনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ রোমানিয়ায় সম্প্রতি বেশ কিছু কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ, ভুয়া চাহিদাপত্র, এমনকি কর্মীদের যাওয়ার মতো ঘটনার অভিযোগ এসেছে দেশটির পক্ষ থেকে। সম্প্রতি ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েলা সেজোনভ টেনে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসব অভিযোগ করেন।

রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী দৈনিক বাংলাকে বলেন, দক্ষ শ্রমিকের অভাব নতুন বাজারের ক্ষেত্রে সব সময় বড় বাধা নয়। যেসব খাতে দক্ষ শ্রমিক লাগে না সেখানে অদক্ষ শ্রমিকও নিয়োগ হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু ফাঁকফোকর আছে। এগুলো বন্ধ করা সম্ভব হয়নি বা হচ্ছে না। আমাদের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি সঠিক কাজ না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কোম্পানির নামে কর্মী নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাজ দিচ্ছে না। আবার কিছু কর্মী আছেন যারা পশ্চিম ইউরোপে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেই রোমানিয়ায় আসেন। এগুলোই হলো বাজার ধরে রাখা বা বাজার সম্প্রসারণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে দক্ষ শ্রমিক একটা বিষয়। তবে প্রধান বাধা হলো মানুষ পাঠানোর পদ্ধতিটা। এই নিয়ে আমরা অনেক চেষ্টা করছি। দেখা যাক কতদূর কী হয়।’

আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস

আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস। ‘থাকব ভালো, রাখব ভালো দেশ, বৈধ পথে প্রবাসী আয়-গড়ব বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

এ উপলক্ষে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, প্রবাসী কর্মীদের মর্যাদা রক্ষায় সবার আগে তাদের দক্ষতা উন্নয়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এবং ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিগুলোতে (আইএমটি) আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্রেডের মানোন্নয়ন, নতুন নতুন কোর্স সংযোজন, এনটিভিকিউএফ-এর আওতায় সনদায়ন, প্রোপার সার্টিফিকেট, পূর্বের শিক্ষার স্বীকৃতি এবং প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন। ৪০টি জেলায় ৪০টি টিটিসি ও চট্টগ্রামে আইএমটি তৈরির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২৫টি টিটিসির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

বর্তমানে নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, চীন, ক্রোয়েশিয়া, সেনেগাল, বুরুন্ডি, সিশেলসে কর্মী পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ সচিব। যদিও এসব দেশে কতজন কর্মী গেছেন সে সংখ্যা উল্লেখ করেননি তিনি।

কর্মী পাঠানোর বিষয়ে গ্রিসের সঙ্গে আগ্রহপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। আলবেনিয়া, মাল্টা ও বসনিয়ার সঙ্গেও প্রেরণ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন।

Related Article