১৬ মার্চ ২০২৫
হোম স্বাস্থ্য সারাদেশ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি ও বাণিজ্য খেলাধুলা বিনোদন আন্তর্জাতিক ধর্ম ও জীবন লাইফ স্টাইল শিক্ষা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পরিবেশ চাকরি বা ক্যারিয়ার মতামত আইন-আদালত কৃষি ও প্রযুক্তি বিশেষ সংবাদ অপরাধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বকাপ ফুটবল
সাহিত্য ও সংস্কৃতি

অভিশপ্তের মুক্তি

১২ অগাস্ট, ২০২৪

মোঃ মনির হোসেন বকাউল,
মাধবপুর উপজেলা (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি

ছবি: মীর মোঃ তানজিরুল ইসলাম (তুষার)

 


তাবাসসুম, তুষার, নাঈম, মুহিব, মুরসালিনা, মুসফিকা, পৃথু, ও ভূমিকা—তারা সাতজন স্কুলজীবনের বন্ধু। 

একসময়কার মজার এবং নির্ভীক গ্রুপ ছিল তারা। শহরের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা ঠিক করল, এবার একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে হবে। 
 

একদিন তারা ঠিক করল, শহর থেকে অনেক দূরে, একটি পুরনো, পরিত্যক্ত পাহাড়ের উপরে থাকা একটি বাড়িতে যাবে। এই বাড়ি নিয়ে প্রচুর ভয়ঙ্কর গল্প প্রচলিত ছিল। অনেকেই বলত, বাড়িটা অভিশপ্ত। একসময় সেখানকার মালিক অদ্ভুতভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়, তারপর থেকে কেউ আর বাড়িতে থাকতে সাহস করেনি।


সন্ধ্যায়, বন্ধুরা রওনা দেয়। শহর ছাড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে যখন তারা পাহাড়ের পথে পৌঁছায়, তখন চারপাশে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে। গাছপালার ভেতর দিয়ে হাওয়া বইতে থাকে, আর সেই বাতাস যেন মৃদু ফিসফিস করে কিছু বলতে চায়। মুহিব ভয়ে কেঁপে উঠে বলে, "তোমরা কি শুনছ? এই হাওয়া যেন আমাদের নাম ধরে ডাকছে!"
"মুহিব, এটা তোমার কল্পনা," তুষার সান্ত্বনা দেয়। তাবাসসুম তুষারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থন করে।
 

তাবাসসুম এবং তুষার ছাড়া বাকিরা একটু চিন্তিত হলেও তারা তাবাসসুমের নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে থাকে। তাবাসসুম ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সাহসী এবং তার বিশ্বাস ছিল যে এই রহস্যময় বাড়ির অভ্যন্তরে কিছু না কিছু লুকিয়ে আছে, যা তাদের উদ্ঘাটন করতে হবে।


অবশেষে তারা সেই ভয়ঙ্কর বাড়ির সামনে পৌঁছায়। চাঁদের আলোতে বাড়িটির প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ছায়া ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। বাড়ির দরজা ছিল অর্ধেক খোলা, যেন তারা আগে থেকেই কারো অপেক্ষায় ছিল। 
 

"আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত," পৃথু নিচু স্বরে বলে। ভূমিকা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
"না, আমরা এসেছি, এখন আর পিছু হটার সময় নয়," তাবাসসুম দৃঢ় কণ্ঠে বলে। তুষারও তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, ইঙ্গিতে সম্মতি জানায়।
 

তাবাসসুম প্রথমে এগিয়ে যায়, তারপর একে একে সবাই ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির ভেতরে ছিল ধূলিমাখা আসবাবপত্র, দেওয়ালে মাকড়সার জাল, আর মেঝেতে পড়ে থাকা প্রাচীন কিছু বস্তু। ঘরের ভেতরে বাতাস ঠাণ্ডা এবং ভারী ছিল, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।


তারা ঘরে ঘরে ঘুরতে থাকে। কিছুই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল না, তবে হঠাৎ করেই মুরসালিনা একটা দরজার কাছে পৌঁছে থমকে যায়। তার মনে হচ্ছিল যেন দরজার অন্য পাশে কিছু একটা আছে, কিন্তু কী—সে বুঝতে পারছিল না।
"ওখানে কি আছে?" মুসফিকা ভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
 

"তুমি কি ভয় পাচ্ছ?" তাবাসসুম জিজ্ঞাসা করে। তার গলায় ছিল নির্ভীকতা, আর তার দৃষ্টিতে ছিল আত্মবিশ্বাস।
মুরসালিনা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে যায়। "আমি... আমি জানি না। কিন্তু কিছু একটা অদ্ভুত..."
"আমি দেখি," তুষার বলে।

সে দরজাটা খুলতে যায়, কিন্তু দরজাটা নিজেই খুলে যায় এক অদ্ভুত শব্দ করে। ঘরটা ছিল পুরো অন্ধকার, তবুও তারা ভেতরে ঢোকে। তাবাসসুম তার টর্চলাইট জ্বালিয়ে ঘরের চারপাশে আলো ফেলে।
ঘরের ভেতরে ছিল একটিমাত্র খাট, আর তাতে একটি পুরনো মোমবাতি, যেটা যেন একবার জ্বলে উঠতে প্রস্তুত ছিল। হঠাৎ করেই মোমবাতিটা নিজে থেকে জ্বলে ওঠে, আর সাথে সাথেই একটা ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।
 

"এটা কীভাবে সম্ভব?" নাঈম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করে।
"কেউ একজন আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে," তাবাসসুম শান্তভাবে বলে। "কেউ চায় আমরা কিছু খুঁজে পাই।"


হঠাৎ করেই ঘরের বাতাস ভারী হতে শুরু করে। মোমবাতির আলো ম্লান হতে থাকে, আর এক অদ্ভুত ছায়া তাদের চারপাশে গড়িয়ে আসে। মুহিব চিৎকার করে উঠে বলে, "আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাই! এখানে থাকা নিরাপদ নয়!"
কিন্তু তাবাসসুম তাকে থামিয়ে বলে, "এখান থেকে কেউ বেরোতে পারবে না যতক্ষণ না আমরা সত্যিটা জানতে পারি।"
এক অদ্ভুত কণ্ঠ শোনা যায়, "তোমরা কি জানো, এই বাড়িতে কী ঘটে গিয়েছিল?"
"তুমি কে?" তুষার দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে। "তুমি কি চাও?"
 

"আমার প্রতিশোধ," কণ্ঠটি ফিসফিস করে। "আমার আত্মা এই বাড়ির সাথে বাঁধা পড়ে আছে। আমাকে বাঁচাতে পারবে কি?"
 

বন্ধুরা সবাই একে অপরের দিকে ভয়ে ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। পৃথু বলল, "আমরা কীভাবে তোমাকে বাঁচাবো? আমরা কিছুই জানি না!"
"তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে সাহসী, তাকে আমার সাহায্য করতে হবে," আত্মা বলল। "তোমরা যদি ব্যর্থ হও, তবে সবাই এখানে আটকে পড়বে চিরদিনের জন্য।"
তাবাসসুম এবং তুষার একে অপরের দিকে তাকায়। তারা জানত, এখন তাদের মধ্যে কেবল তারা দুজনই এই বিপদ থেকে তাদের সবাইকে রক্ষা করতে পারে।


আত্মা তাদের বলল, "এই বাড়ির মালিক ছিল একজন নিষ্ঠুর মানুষ। তিনি তার পরিবারকে অত্যাচার করতেন, এবং একদিন তার অত্যাচারের শিকার হয়ে তারা সবাই আত্মহত্যা করে। সেই থেকে তাদের আত্মাগুলো এই বাড়িতে বন্দি হয়ে আছে।"
"তোমাদের কাজ হবে তাদের আত্মাগুলোকে মুক্ত করা," আত্মা বলল। "কিন্তু সেটা সহজ হবে না। তোমাদের ভেতরে থাকা ভয়কে জয় করতে হবে, নাহলে তোমরাও এই বাড়ির অংশ হয়ে যাবে।"
তাবাসসুম, তুষার, এবং বাকিরা বুঝতে পারে, এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তারা জানত, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে একমাত্র সাহসই তাদেরকে রক্ষা করতে পারে।


তাবাসসুম প্রথমে এগিয়ে যায়, তারপর তুষার। তারা বাড়ির ভেতরের প্রতিটি কোণ খুঁজতে শুরু করে। তাদের পিছু পিছু নাঈম, মুহিব, মুরসালিনা, মুসফিকা, পৃথু, ও ভূমিকা সবাই থাকে, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ভয়ে কাঁপতে থাকে।
তুষার বলল, "আমরা যে যেখানে পারি, সেখানে খুঁজে দেখি। এখানে কোথাও একটা সূত্র আছে, যেটা আমাদেরকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারবে।"
তাবাসসুম এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে খুঁজতে থাকে। তারা একে একে ঘরের প্রতিটি কোন খুঁজে দেখে, কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না।


অনেকক্ষণ পর, যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন তাবাসসুম হঠাৎ করেই দেখে মেঝেতে কিছু লেখা রয়েছে। সেই লেখা যেন এক পুরোনো ভাষায়। তাবাসসুম সেটা পড়তে শুরু করে এবং বুঝতে পারে, এই লেখাগুলো ছিল এক প্রাচীন মন্ত্র। 
"আমরা এটা নিয়ে কী করব?" মুসফিকা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"এটা একটি মন্ত্র," তাবাসসুম বলল। "যদি আমরা ঠিকমতো পড়তে পারি, তবে এই বাড়ির অভিশাপ ভাঙতে পারব।"
তুষার তাবাসসুমের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "তাহলে পড়ো, তাবাসসুম। আমরা তোমার সাথে আছি।"


তাবাসসুম সেই প্রাচীন মন্ত্র পড়তে শুরু করে। তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত সুর যা তাদের চারপাশের বাতাসকে ভারী করে তোলে। মুহিব, মুসফিকা, পৃথু, ভূমিকা সবাই মন্ত্রের প্রতিটি শব্দে কেঁপে উঠতে থাকে। তুষার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চেহারায় সাহসের ছাপ, কিন্তু তার মনের গভীরে কিছু একটা অজানা ভয়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল।
 

মন্ত্রের শেষ অংশটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায়। দেওয়ালের মাকড়সার জালগুলো ছিঁড়ে যেতে শুরু করে, বাতাসে যেন হাজারো ছায়া নাচতে থাকে। নাঈম আর মুহিব ভয়ে মেঝেতে বসে পড়ে, মুরসালিনা আর মুসফিকা তাবাসসুমের পাশে এসে দাঁড়ায়, যেন তারা তার থেকে সাহস পেতে চায়।
 

"তোমাদের কাজ শেষ হতে চলেছে," আত্মার সেই ফিসফিসানি আবার শোনা যায়। "এখনো সময় আছে, যদি তোমরা পালাতে চাও। কিন্তু তোমরা যদি শেষ পর্যন্ত থেকে যাও, তাহলে হয় অভিশাপ মুক্তি পাবে, নয়তো তোমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।"
তাবাসসুম মন্ত্রের শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করে। সাথে সাথে একটি তীব্র আলোর ঝলকানি পুরো বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের জন্য, তারা সবাই কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, শুধু আলোর সমুদ্রে ডুবে ছিল।


আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে, তারা দেখতে পায় যে ঘরের মধ্যে থাকা সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। মোমবাতির আগুন নিভে গিয়েছে, বাতাসে এক ধরনের শান্তির স্রোত বইতে শুরু করেছে। ঘরের কোণ থেকে এক একটি মৃদু কণ্ঠ শোনা যায়—কাঁদতে থাকা, হাসতে থাকা, এবং শেষ পর্যন্ত শান্তির নিঃশ্বাস ফেলা।
"আমরা... আমরা কি সফল হয়েছি?" মুরসালিনা জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ," তাবাসসুম মৃদু হেসে বলে। "তাদের আত্মা মুক্তি পেয়েছে।"
তুষার বলে, "তুমি সত্যিই অসাধারণ, তাবাসসুম। যদি তুমি না থাকতে, আমরা কেউই বাঁচতে পারতাম না।"
"আমরা সবাই মিলে এটা করতে পেরেছি," তাবাসসুম বলেন। "এটা শুধু আমার কাজ ছিল না, আমাদের সবার মিলিত সাহসই আমাদের রক্ষা করেছে।"


বন্ধুরা সবাই মিলে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায়। চারপাশে অন্ধকার নেই, শুধু পূর্ণিমার আলোতে পাহাড়টা যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। তারা সবাই যেন একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে।
"তোমরা সবাই ঠিক আছ?" ভূমিকা জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ, আমি মনে করি, আমরা সবাই ঠিক আছি," পৃথু উত্তরে বলে। "এটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমরা এটা পার করেছি।"
তুষার বলে, "তাবাসসুম, তুমি ছিলে আমাদের শক্তির উৎস। তুমি না থাকলে, আমরা সবাই ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতাম।"
তাবাসসুম হেসে বলে, "আমাদের সবার ভেতরেই সাহস আছে, শুধু সেটা খুঁজে পাওয়াটাই আসল।"
তারা সবাই মিলে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে রওনা দেয়। রাস্তা ধরে গাড়ি চলতে থাকে, আর তাদের মুখে ছিল এক অপরিসীম প্রশান্তি। ভয়ঙ্কর বাড়িটা তাদের স্মৃতিতে থাকলেও, তারা জানত, তারা সবসময় একে অপরের পাশে থাকলে, কোনো কিছুই তাদের ভীত করতে পারবে না।


ফিরে আসার পর, তারা সবাই বুঝতে পারল, তাদের বন্ধুত্ব আগের চেয়ে আরও গভীর হয়েছে। তাবাসসুম এবং তুষারের সাহসিকতা তাদের সবার মাঝে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, ভয় যতই বড় হোক না কেন, সাহসিকতা, বন্ধুত্ব, আর পারস্পরিক বিশ্বাস সবসময় তাদের রক্ষা করবে।
তাদের এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবনের নতুন দিক উন্মোচন করল। তারা জানত, যে কোনো বিপদে তারা একসাথে লড়াই করবে, এবং কখনো পিছু হটবে না।

Related Article