১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
ছবি: প্রতিকী
সুখের মা গল্পের কুঁজো বুড়ির মতো কুঁজো হয়ে লাঠি ঠক ঠক করে হাঁটতেন। এদিকে সুখিলাল নামেই সুখি ছিলেন, আদতে বেচারা সুখির সংসারে কোন সুখ ছিলোনা। বৌ, মা আর ঘর ভর্তি এক জাঙ্গাল পোলাপানের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। সুখের মায়ের কাজ করার শক্তি-সামর্থ্য বহু আগেই গত হয়েছে। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। তবে ভিক্ষার জন্য নয়। বউ-জীদের রান্নার সময় একটু কুটে-বেছে দিতেন, ছোট বাচ্চাটাকে একটু সামলে দেয়ার বিনিময়ে বাড়ি ফেরার সময় দুমুঠো ভাত খেয়ে আসতেন। আমার দাদীর সাথে সুখের মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। দাদী ছিলেন দিলদরিয়া মানুষ। আমার মা বলতেন, সুখের মা তোমাকেও অনেক কোলে-কাখে নিয়েছে। বুড়ির জন্য আমার খুব মায়া হতো। বুড়ি আমাদের দুই ভাইকে বলতেন 'সোনা'। আমার বোনকে বলতেন," তুই 'মুনা' (চিটে ধান, পঁচা সরিষাকে মুনা বলে), তোর ভাইয়েরা 'সোনা', তুই ম্যায়া মানুষ, তোর দাম নাই।" শুনে আমার বোন বুড়িকে খুব বকতো, আমরা হাসতাম।
বয়সজনিত কারণে বুড়ি এক সময় শয্যাশায়ী হলেন। যতদিন ঘরে পড়ে ছিলেন, খুব অযত্নে ছিলেন। মানুষ গরুও এরচেয়ে যত্নে রাখেন। বুড়ির ঘরের কাছ দিয়ে গেলে গু-মুতের গন্ধে বমি আসতো। একে অভাব, দুইয়ে প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কারের ভয়ে বুড়িকে ঠিকমতো খাবার দেয়া হতোনা। দজ্জাল বৌয়ের ডরে পাড়ার মানুষ ছিলো নিরব দর্শক। পাড়ার কেউ খাবার দিলেও দজ্জাল মহিলা বকাবকি করতো। চিৎকার চেচামেচিতে মাঝেমধ্যেই শুনতাম, "পাড়ার নটিগো খাবার খাইয়া, মাগীয়ে ঝাহা ভইরা আগে (পায়খানা করে), নটিরা খাওন দেয়, গু-মুত আমার ছাপ করন নাগে ক্যা।" বাড়ির কাছে দিয়ে গেলে বুড়ি "ভাত দে..রে" চিৎকার শোনা যেতো। আমার দাদী শুনে কষ্টে বুড়িকে বকতেন আর বলতেন," মাগী কি যমের ঘর বাইন্ধা আইছে, মাগীরে আল্লায় নেয়ন্যা ক্যা।"
একদিন সন্ধ্যায় বুড়ির ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। বুড়ি ভাতের জন্য চিৎকার করছিল। বাড়ি ফিরে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। ভাতের জন্য একজন অসহায় মুমূর্ষু মানুষ চিৎকার করছে। আমার ১২/১৩ বছরের আবেগি মন। বুড়িকে ভাত দেয়া রিক্স দজ্জাল মহিলা বাড়ি সুদ্ধ মানুষকে বকবে। এখনকার দিন হলে নিশ্চয়ই ৯৯৯ ফোন করতাম।
যাই হোক, অন্ধকার একটু জমাট হলে বাড়ির সবার অজান্তে এক থালা ভাত-তরকারি নিয়ে খুব সতর্কতার সাথে রাস্তায় লুকিয়ে লুকিয়ে বুড়ির ঘর পর্যন্ত গেলাম। ভাঙ্গা দরজা, সর্বদা খুলাই থাকে। বুড়ি পায়ের আওয়াজ পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, " ক্যারা?" জবাবে বলি, " আমি... জামালের পোলা, ভাত নিয়া আইছি, শব্দ কইরোনা, চুপচাপ খাও।" বুড়ি শোয়া থেকে উঠে বসে। আমার হাতে দুই ব্যাটারীর বাঘ মার্কা লাইট। লাইটের টিমটিমে আলোয় বুড়ি চুপচাপ খায়। মানুষ ভাত এমন করে খায়, আমার জানা ছিলোনা। মাটির কলসি থেকে গ্লাসে পানি ভরে বুড়ির হাতের নাগালে রাখি।
হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ শুনে ভয় পাই। লাইট বন্ধ করে আস্তে আস্তে চলে আসি। পরের দিন সকালে শুনি তুলকালাম কান্ড। বুড়ির ছেলের বৌ থালা নিয়ে তদন্তে নেমেছে; পাড়ার কোন নটি ভাত দিয়ে গেছে, তিনি তা বের করেই ছাড়বেন। লোকমুখে শুনলাম, বুড়িকে জিজ্ঞেস করে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, তিনি নাকি কাপড়-চোপড় পায়খানায় নষ্ট করে কেবল ফেল-ফেলিয়ে তাকিয়ে বসে আছেন।
বাড়িতে একটা থালা কম হওয়ায়, মা বুঝেছিলেন ওটা আমাদেরই থালা এবং লুকিয়ে ভাত-তরকারি আমার দাদীই দিয়ে এসেছেন। অসুস্থতায় শুয়ে শুয়ে অতীত চারণ করছি... ২৪/২৫ বছর আগের ঘটনা। আমার দাদী আর সেই সুখের মা কেউ বেঁচে নেই। নিছক ভাতের অভাবে এখন কেউ আর চিৎকার করেনা।
লেখক- মোঃ তারেকুল ইসলাম
প্রভাষক (বাংলা)
১১.০২.২০২৩খ্রি.