২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
ছবি: সংগৃহীত ছবি
সব ভাষারই স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। আল্লাহ সব ভাষাই জানেন এবং যে ভাষায় তাঁকে ডাকা হোক না কেন, তিনি তা বুঝতে পারেন। দুনিয়ায় যে শত শত ভাষা রয়েছে, সেগুলো আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। কেননা, হযরত আদম (আ.) ছাড়া অন্য সব নবী-রাসুলের প্রতি আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে তাঁদের মাতৃভাষায়।
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম ‘মাতৃভাষা’। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের স্বভাষায় নবী রাসুল ও আসমানি কিতাব প্রেরণ করে মাতৃভাষার মাহাত্ম্য বুঝিয়েছেন। ভাষা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্যতম নিয়ামত। পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা রয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বিশ্বে ভাষার সংখ্যা ২৭৯৬টি। পরিবেশ-পরিস্থিতি তথা আবহাওয়াজনিত কারণে বাকবিন্যাস বৈচিত্র্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার প্রেক্ষাপটে ভাষায় বিভিন্নতা আহরহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে ভাষার ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য রয়েছে। এ বৈচিত্র্য মানুষের হাতে তৈরি নাই। এটা আল্লাহ পাকের সৃষ্টিজগতে এক রহস্যময় নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মধ্যে বলেন, ‘তার নিদের্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ সুরা রুম : ২১
মাতৃভাষার মাধ্যমে সহজে মানুষকে যা বোঝানো যায় তা অন্য ভাষায় সহজে বোঝানো যায় না। তাই আল্লাহ তায়ালা নিজেই প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ নিজ নিজ জাতির নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। যেমন হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানী তাই সে ভাষায় তাওরাত কিতাব নাজিল করেছিলেন । হজরত দাউদ (আ.)-এর কওমের ভাষা ছিল ইউনানী তাই যাবুর সে ভাষায় নাজিল করেছিলেন। হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির ভাষা ছিল সুবিয়ানি তাই এ ভাষায় ইঞ্জিল কিতাব নাজিল করা হয়েছিল। বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (স.)-এর উম্মতের মাতৃভাষা ছিল আরবি তাই কোরআন তার মাতৃভাষা আরবিতে নাজিল করেছিলেন। আসমানি কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাজিল না করতেন তাহলে এসব অবতরণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। আল্লাহ তায়ালা যদি এভাবে নবী-রাসুলদের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে আসমানি কিতাব প্রেরণ না করতেন তবে দেশবাসী এই ঐশী ধর্মগ্রন্থের হেদায়েত ও কল্যাণ লাভে বঞ্চিত হতো। মাতৃভাষার শিক্ষা ও বিকাশে অকুণ্ঠ সমর্থনে আল্লাহর বর্ণনা সাবলীল ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য নবীদেরকে সংশিষ্ট জাতির ভাষাজ্ঞান দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। অন্যত্রে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাজ্ঞান দিয়ে পাঠিয়েছি তাদের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য।’
সুরা ইবরাহিম : ৪)
ইসলাম প্রচারে বাংলা ভাষার অবদান অনেক । বাঙালিদের একমাত্র নিজস্ব ভাষা হলো বাংলা। পূর্ব যুগে পুঁথি সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার হতো। তখনকার সময়ে মানুষ সারা দিন কাজ করে ঘরের উঠানে বসে পুঁথি শুনত। সেখানে ইসলামের প্রচার প্রসার হতো। আমরা জানি, ১২০৩ সালে তুর্কিবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
যখন বৃটিশরা প্রথম এদেশে এসেছিল তখন তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি এই অঞ্চলে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, নির্বিশেষে সব ধর্মের বুদ্ধিজীবিরা সে নিষেধাজ্ঞা এবং ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে বাংলা ভাষায় বিবিধ সাহিত্য রচনা করে এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। দেশ জাতি এবং মানবতার সার্বিক কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের নবী মুহাম্মদ সঃ বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলেছেন। তার উপস্থাপনা ও আলোচনা এবং বাচনভঙ্গি ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যে সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী এবং আরবের সবচেয়ে সুন্দর বিশুদ্ধ ভাষী ছিলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তোমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বল।’ (সুরা বাকারা : ৮৩)
মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর সব দেশের ভাষা ও জাতিগত পরিচয় আছে। ভাষা হলো ভাব বিনিময় ও প্রকাশের পৃরতিকী প্রত্যয় বিশেষ। আর মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তান শাসকরা। আমাদের দেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালীর পরিচয় তুলে ধরার জন্যই ২১শে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী এই দিনটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্র জনতার প্রাণের দাবি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই ৫২'র একুশ আমাদের চেতনা, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব। বাঙালীরা মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে থাকে। একের পর এক ভারি হতে থাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। বাংলাভাষার দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মেনোফেস্টো ও বুদ্ধিজীবীদের লেখার মধ্য দিয়ে এ দাবি সামনে আসে। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের ভূমিকা বেশি ফুটে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা" শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। একই বছরের ৩০ জুলাই দৈনিক আজাদের প্রকাশিত "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা"
শীর্ষক নিবন্ধে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন- এটা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতির বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক সায়িত্ব শাসিত ও অনিয়তন্ত্রন অধিকারের বিগর্হিতও বটে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গে ধর্মঘট ছিল। ঐদিনেই বাংলার মানুষসহ পৃথিবীর সব মানুষ জানতে পারল পূর্ববাংলার জনতার দাবি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষিত জনতা, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী সবারই ধর্ম ঘটে অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বাঙালি ও নিজের ভাষাভিত্তিক পরিচিতি ধারণ করার জন্য সংগ্রামী জনতা রাজপথে অবস্থান করে। ১১ মার্চ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এর নির্দেশে পুলিশ গুলি চালাই ছাত্র জনতার উপর। পুলিশের গুলির কারণেই ভাষা আন্দোলনের গতি তীব্র গতিতে রুপ নেয়। দিন যত যায় ততই গরম হতে থাকে ঢাকা। এতো সংগ্রাম আন্দোলনকে তোয়াক্কা না করে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি মুসলিম লীগ কাউন্সিলে প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। আরও একবার জ্বলে উঠল বাঙালিরা। ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল করে। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট করে। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানির সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। ৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে ধর্মঘট, সভা, মিছিল, পিকেটিং হয়।২১ ফেব্রুয়ারী কর্মসূচি পালনের জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা দেয়। আর ঐ দিনেই পুলিশ ক্ষিপ্র হয়ে গুলি চালাই ছাত্র জনতার উপর আর ঐ গুলিতে শহিদ হয় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আরও নাম না জানা অনেকে।আর ইতিহাসের পাতাই জায়গা করে নিল ৫২'র ২১শে ফেব্রুয়ারী। এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে পালিত হচ্ছে " আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস " হিসাবে। এটাই বাঙালির ঐতিহ্য আর বাঙালি জাতীর ব্যাঘ্র থাবার অর্জন।
সাইফুর রহমান বাদল,
লেখক,কলামিস্ট ও সাংবাদিক।