২০ মার্চ, ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত
দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ তছরুপ, ভূয়া নিয়োগ, জাল সনদ ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা নানা অনিয়ম করার পরও অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে যাওয়ার অহরহ নজির রয়েছে। তবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাল সনদ ব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়মের লাগাম টানতে কঠোর হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি নিবন্ধন সনদ না থাকা, নিয়োগে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগে মন্ত্রণালয় থেকে অন্তত ৩০ শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যেসব শিক্ষক ও কর্মচারী ভূয়া তথ্য দিয়ে একাধিক টাইম স্কেল ও এমপিওর অর্থ নিয়েছেন, তাদেরকে সরকারি কোষাগারে অর্থ ফেরতেরও নির্দেশনা দেয়া হয়। খুব শীঘ্রই জাল সনদ ব্যবহারের অভিযোগে ৮১৪ শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাল সনদের বিষয়টি তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। চলতি সপ্তাহে এই সংস্থাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৮১৪ শিক্ষকের জাল সনদ ব্যবহার করছেন এমন তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিও ও নিয়োগ বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ফলে দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাল সনদ ব্যবহার করে অসংখ্য শিক্ষক চাকরি করছেন। এসব শিক্ষকের নিয়োগেও ঘুষ ও দুর্নীতি রয়েছে।
অভিযোগ আছে, মাউশির একটি চক্রের মাধ্যমে এসব শিক্ষকরা ভূয়া সনদ ব্যবহার করার পরও এমপিওভুক্ত হচ্ছেন সহজেই। ঘুষের মাধ্যমে এসব শিক্ষক এমপিও ভোগ করছেন বছরের পর বছর। এর ফলে সরকারের প্রতি বছরে ক্ষতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। সম্প্রতি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা জাল সনদ ব্যবহার করছেন শিক্ষকরা তাদের তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে নিরীক্ষা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকের সনদ যদি জাল হয় তাহলে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ডিআইএ একারণেই মাঠ পর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাল সনদ যাচাইয়ের কাজ করে আসছে।
সনদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সনদ পাঠিয়ে সনদের সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তবে এবার যেকোন সময়ের চেয়ে তড়িত ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও আইন বিভাগের যুগ্মসচিব মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপসচিব মিজানুর রহমান, ডিআইএ যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস ও মাউশির এক কর্মকতা উপস্থিত ছিলেন। সভায় অন্তত ৩০ শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তবে যেসব শিক্ষক চাকরি জীবন শেষ করে অবসরে গেছেন মানবিক বিবেচনায় এমন দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সভা সূত্রে জানা যায়, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক (শরীরচর্চা) পদে আরিফা চাকলাদারকে নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। তিনি ২০১০ সালে ২ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। ওই বছরের মে মাসে ৮ হাজার টাকা স্কেলে এমপিওভুক্ত হন। একইভাবে হিন্দু ধর্ম বিষয়ে সহকারী শিক্ষক পদে পশুপতি বিশ্বাসকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, এই দুই শিক্ষকের নিয়োগ বিধি সম্মতভাবে দেয়া হয়নি।
নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার থেকে যে অর্থ তারা নিয়েছেন তা ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে পশুপতি বিশ্বাসকে ১৮ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৫ ও আরিফা চাকলাদারকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
চাঁদপুর হাজীগঞ্জের শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল যোগদান করেন। কিন্তু ডিআইএ যখন পরিদর্শনে কলেজটিতে যায় তখন এই অধ্যক্ষ পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ দেখাতে পারেননি। একই প্রতিষ্ঠানের প্রভাষক আহম্মেদ উল্যাহ, মাছুম বিল্লাহ, আবু ইউসুফ, তাছমিয়া ফেরদৌস, মো. সাইফুল ইসলাম, ওমর ফারুক, মফিজুল ইসলাম ও জহির উদ্দিন নিবন্ধন সনদ দেখাতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সনদ দেখাতে ব্যর্থ হলে এমপিওভুক্তির আবেদন করতে পারবেন না এসব শিক্ষক।
একইভাবে নেত্রকোণার মোহাম্মদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) মাকসুদা আক্তার ২০০৪ সালের ১২ জুলাই স্কুলটিতে যোগদান করেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি এমপিওভুক্ত হন। তখন তিনি যে কম্পিউটার সনদ জমা দিয়েছেন তা বগুড়ার প্রশিক্ষণ একাডেমীতে পাঠানো হয়। এরপর দেখা যায়, তিনি যে সনদ দেখিয়ে চাকরি ও এমপিও পেয়েছেন তা ভূয়া। এর ফলে এই শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) বিশ্ব নাথ রায় ২০০২ সালে স্কুলটিতে যোগদান করেন এবং ২০০৫ সালে এমপিওভুক্ত হন। এমপিওভুক্তির সময় তিনি যে কম্পিউটার সনদ জমা দিয়েছেন তা বগুড়ার জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমীর যে কম্পিউটার সনদ জমা দেন। দেখা যায় তা ভুয়া।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ডিআইএ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সনদ সরবরাহকারী সংস্থার কাছে আবারও যাচাই বাছাইয়ে পাঠায়। তাদের পাঠানো প্রতিবেদন অনুসারে মাধ্যমিক ও উচ্চ বিভাগের সচিবের নের্তৃত্বে একটি কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। শিক্ষকদের মধ্যে জাল সনদ ব্যাবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
এ বিষয়ে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি জাল সনদ যাচাইয়ের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা আশা করছি খুব শিঘ্রই জাল সনদধারী শিক্ষকদের অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত ও তাদের নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।