৩০ এপ্রিল ২০২৫
হোম স্বাস্থ্য সারাদেশ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি ও বাণিজ্য খেলাধুলা বিনোদন আন্তর্জাতিক ধর্ম ও জীবন লাইফ স্টাইল শিক্ষা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান পরিবেশ চাকরি বা ক্যারিয়ার মতামত আইন-আদালত কৃষি ও প্রযুক্তি বিশেষ সংবাদ অপরাধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বকাপ ফুটবল
স্বাস্থ্য

চোখ ওঠা যেভাবে হয়ে উঠলো ‘জয় বাংলা’ রোগ!

০৭ অক্টোবর, ২০২২

আব্দুল্লাহ হিল কাইয়ূম,
বার্তা সম্পাদক

ছবি: সংগৃহিত

চোখের কনজাঙ্কটিভায় ভাইরাসজনিত একধরণের সংক্রমণ বাংলাদেশে পরিচিত ‘চোখ ওঠা’ নামে। অতি পরিচিত এবং অত্যন্ত্য সংক্রামক এই রোগটির ওপার বাংলায় রয়েছে আরও একটি নাম। আর সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য যোগসূত্র! 

১৯৭১ সালে মহামারী আকারে পশ্চিম বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। রোগটি পূর্ব বাংলায় চলা মুক্তিযুদ্ধের কারণে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসা বাঙালি শরণার্থীদের কারণেই ছড়িয়েছিলো বলে এর নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা’ রোগ! 

‘জয় বাংলা’র প্রকোপ ছিলো এতোটাই, যে সেসময় ৫০ লাখেরও বেশি লোক এই রোগে ভুগেছেন। তখনকার পত্রিকাগুলোর সংবাদ ঘাঁটলে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই জানা যায়। 

এই রোগ কল্যাণী, চাপড়ার বড় আন্দুলিয়া, বেতাই, করিমপুর, শিকারপুর শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় এটি আক্রমণ করে কলকাতা শহরের শিবিরগুলোর শরণার্থীদেরও। 

আক্রান্তদের মধ্যে শরণার্থীরা যেমন ছিলেন তেমনি সংক্রামক এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন স্থানীয় অধিবাসীরাও। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবমতে প্রায় ৫ লাখ লোক অ্যাকিউট হেমোরেগেজিং কনজাঙ্কটিভাইটিস এর চিকিৎসাসেবা নেন।  কলকাতা শহরের শতকরা ৬৫ জন লোক এই রোগে আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছিলেন জর্জ চাইল্ডস কোন তার ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ । এই এএইচসি ‘চোখ ওঠা’ বা কনজাঙ্কটিভাইটিস-এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভ্যারাইটি। 

‘জয় বাংলা’য় কলকাতা শহর কতটা বিপর্যস্ত ছিলো, ৪ জুন ১৯৭১এর দৈনিক যুগান্তরের একটি শিরোনামে তা স্পষ্ট। ‘চোখের রোগে ট্রেন বন্ধের আশঙ্কা’ শিরোনামের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, চোখ-ওঠায় রেলওয়ের বিপুলসংখ্যক কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের ৪৯ জন গার্ড এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ছুটি নিয়েছেন। বহুসংখ্যক বুকিং ক্লার্ক চোখের রোগে আক্রান্ত। সাধারণ ছুটিতে থাকা ২৭ কর্মীর ছুটি বাতিল করেও ট্রেন-চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। 

চোখ-ওঠায় বাতিল হয়ে গেছে ফুটবল ম্যাচ। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। পত্রিকার পাতায় পাতায় চোখের রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার বিজ্ঞাপন, কেউ-বা দিচ্ছে হোমিওপ্যাথিকের বিজ্ঞাপন, কেউ-বা সালফাসিটল কিংবা তরল সাবানের বিজ্ঞাপন। 

এই রোগ নিয়ে মশকরা করতেও ছাড়েনি তখনকার দৈনিকগুলো। পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রের চোখে চশমা। গোড়াতেই পাত্রীর প্রশ্ন. ‘চোখ উঠেছে’? চোখ-ওঠা নিয়ে যুগান্তর এ কাটুনিস্ট এঁকেছেন এমনই অনবদ্য এক কার্টুন।তখনকার যুগান্তর এর রবিবারের সাময়িকী রম্য করে লিখেছেন, 

‘জ্বালা দিতে ঠাঁই নাই জ্বালা দেয় সতীনের ভাই, কলকাতার লোকের হয়েছে সেই দশা। একেই তো জ্বালা-যন্ত্রণার সীমা নেই, তার ওপরে কোথা থেকে এক চোখের রোগ এসে চেপে বসল। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’ ডাক ছাড়তে ছাড়তে সারা শহর যেন কটা দিনের জন্যে… ধুলি পড়ে একেবারে কলুর বলদ হয়ে গেল!’ 

বাংলাদেশি সাহিত্যেও ছাপ পড়েছে এই ‘জয় বাংলা’র। আহমদ ছফা ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে লিখেছেন, 

‘কলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানিং (১৯৭১) ‘জয় বাংলা’ শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা যেন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম ‘জয় বাংলা’ স্যান্ডেল।… যে চোখ-ওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, কলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিল ‘জয় বাংলা’।’ 

চোখ-ওঠা পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি প্রভাব ফেলেছিল একাত্তরে, স্থানীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল জয় বাংলার প্রাদুর্ভাবের কথা। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের জয় বাংলায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ ছাপে। বাংলাদেশের সংবাদ সংগ্রহে এসে পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন চোখের এই প্রদাহে। 

এখনও এই রোগটি পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানেই ‘জয় বাংলা’ বলে পরিচিত বলে জানিয়েছেন কবি ও সাংবাদিক প্রদীপ কর' গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখনও আমাদের ওখানকার গ্রামগুলোতে এই রোগকে জয় বাংলাই বলে। আমার নিজস্ব ধারণা, বাংলাদেশের পতাকায় যে সবুজের ভেতরে লাল সূর্য দেখা যায়, সেরকমই এই রোগে চোখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে বলেই হয়তো একে এখনও জয় বাংলা বলে।’ 

তিনি জানান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে এই ‘জয় বাংলা’র উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদও তার লেখায় এই রোগের কথা উল্লেখ করেছেন। 

কলকাতাবাসীকে চরম অসুবিধায় ফেলে দিলেও যুদ্ধের ময়দানে এটি সুবিধা করে দিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের! ডি ডি প্রমাণিক তার হবেষণা নিবন্ধ ‘জয় বাংলা : অ্যান এপিডেমিক কনজাঙ্কটিভাইটিস ইন ইন্ডিয়া’তে জানান পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি এই রোগে আক্রান্ত হয় পূর্ব বাংলায় অবস্থান করা পাকিস্তানি সৈন্যরাও। পাকবাহিনীর ভোগান্তিটা একটু বেশিই ছিলো, কারণ এই রোগের সঙ্গে তারা খুব একটা পরিচিত ছিলো না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই মহামারী কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্যাকটিকালি গেরিলা যোদ্ধাদের কিছুটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। সেকারণে মুক্তিযোদ্ধারাই একে ডাকতে শুরু করেন ‘জয় বাংলা রোগ’ নামে! ৫১ বছর আগের সেসব দিনের স্মৃতি আজও অমলিন কালের সাক্ষী হয়ে থাকা পশ্চিম বাংলার অনেক অঞ্চলের স্থানীয়দের কাছে। এখনও তাই এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে উঠে আসে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অনন্য সেই স্লোগানের নাম!

তথ্যসূত্র

Related Article